দুর্নিবার সুজনের গুচ্ছকবিতা



দুর্নিবার সুজন
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পৃথিবীর পিঠে বসে

চুম্বকীয় আকর্ষণ বিকর্ষণেই অভিকর্ষ-বল আমাকে নক্ষত্রদের দিকে
টানে না। পৃথিবী একটা বর্তুলাকার চুম্বক হয়ে প্রদক্ষিণ করে তোমাকে
নিয়ে। পৃথিবীর পিঠে বসে, তুমি আমিও জড়িয়ে থেকে কিংবা দূরত্ব
নিয়ে ঘুরি একই কক্ষপথে। পিঁপড়েদের কক্ষপথ একই হলেও কে কার
ভাষা বোঝে বলো! সকালের ব্রেকফাস্টে ব্ল্যাক কফি বানাতে গেলে
দেখি, চিনির বয়ামে হাজারো পিঁপড়া তাদের খাবার নিয়ে মত্ত।

ডাস্টবিন থেকে ছয়জন পিঁপড়া একটা ভাত নিয়ে উঠে যাচ্ছে পাইপ
বেয়ে। তাদের প্রতি আমার মায়া লাগে। তাদের যুথবদ্ধ চলাচল দেখি,
তাদের চুরি দেখি, ঘুষ দেওয়া দেখি, দুর্বলের প্রতি অত্যাচার দেখি
কর্মী পিঁপড়েদের নিরন্তর সংগ্রাম দেখি, পুরুষ পিঁপড়েদের অলস
বসে থাকা দেখি। ঘোর নিয়ে দেখি তাদের আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম।
অতঃপর আমি, আমি হয়ে যাই; খুনী হয়ে যাই! ব্ল্যাক কফি বানানোর
সংগ্রামে শত পিঁপড়েকে ভাসিয়ে দেই পানিতে। মৃত পিঁপড়েদের শরীর
ড্রেন বেয়ে চলে যায় তাদের নিজস্ব কবরে, সৎকারহীন!

তাদের সন্মিলিত শোকের ভাষা আমার বোঝা হয় না। তাদের সন্মিলিত গালি
মানুষ জাতের প্রতি আমি বুঝতে পারি না। তারাও কি একে অন্যকে
ধর্ষণ করে, খুন করে বলে‘আহা, কী মানবিক অত্যাচার!’

মৌমাছি, উঁইপোকা, মশা, ছারপোকা, ভীমরুল, তেলাপোকাদের সাথে
সহবাসে আমি প্রায়ই খুনি হয়ে যাই, আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে যাই।
সবার উপরে মানুষ সত্য হয়ে যাই! আমার প্রবৃত্তিতে আছে নিজেকে
শ্রেষ্ঠ বলার প্রবণতা। তাই আমি আর সব প্রাণীদের ভালোবাসার মহত্ত্ব
দেখাই; ভালোবেসে খেয়ে ফেলি হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল সব। ঘৃণায়
মেরে ফেলি ছারপোকা, তেলাপোকা! তারপর আমি অহিংসবাদী হয়ে যাই!
আমি মহত্ত্বকে ছুঁতে চাই। মুরগি না খেলে আমাকে পাঙ্গাস, রুই খেতে হয়
তার চেয়ে বেশি অহিংস হলে কচকচে পুঁই ডাঁটাদের, লাউ ডাঁটাদের
সন্মিলিত ক্রন্দনে, বিরহে জগদীশ বসু উদ্ভিদের প্রাণে সংগীতের খোঁজ পায়।
তাদের ড্যান্স-ফেস্টে যে সংগীত বাজে তার ভাষা না বুঝে
পার করে দিচ্ছি একটা জীবন!

প্রিয় মাকড়সা,
তোর অদ্ভুত ঘরের মতো আমার ঘরও কি তোর কাছে অদ্ভুত লাগে?
এতসব অট্টালিকায় তুই সবখানে শুনতে পাশ কি মানুষদের শীৎকার,
চিৎকার? লোভ, ঘৃণা, হিংসা, ভয়? তুই আমার সব কথা বুঝিস?
বুঝিস, আমার দ্বিচারি চরিত্র? আমি মানুষ; আমি এরকমই। আমি আমার
প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে বন্দী! আমি বুঝতে পারি,
চুম্বকীয় আকর্ষণ বিকর্ষণেই অভিকর্ষ-বল আমাকে নক্ষত্রদের দিকে টানে না!

কোলাজ গল্প - ৪

তুমি আমাকে পাত্তা না দিলে একটা নিরুদ্দেশের নিঃসঙ্গ বিবাগী নৌকায়
বেড়িয়ে পড়ব। পরিবারকে, সমাজকে, দলকে, দেশকে ভালোবেসেছি
অনেক। সময়ে এরা সকলেই পরিচয়ের হিংস্রতায় উগ্র হয়ে ওঠে দ্বেষ যেন
মানব-প্রবৃত্তির মজ্জায়, এসবে রাজনীতি নির্মোহ, নির্লিপ্ত, নিশ্চল;
ফ্রয়েড আইনস্টাইনকে চিঠি লিখল অসহায়ত্বের। বিবেকহীন প্রবৃত্তির
প্রতিষেধক নেই; যুদ্ধ অনিবার্য; জাতি সাম্রাজ্যের ভেদ রেখার লাগাম
কে টানবে! তাই যুদ্ধ তোমার আমারও; সহবাসে, মতবাদে-মতভেদে
আইডেন্টিটিকে ছুড়ে ফেলে অহিংসার গঙ্গাস্নান নিই চলো।

আহা, বীর্যময় গঙ্গা। আহা, মহাভারত! গঙ্গাকেও বিয়ে করলো শিব!
কপোতাক্ষ আর ব্রহ্মপুত্র নদ গঙ্গার মানবায়নে ক্ষেপে ওঠেনি কি?
ব্রহ্মপুত্রের ক্রাশ ছিল গঙ্গা? সেই থেকে নদী ও মানুষের দ্বন্দ্ব?
পাড়ভাঙ্গা মানুষের আহাজারিতে শিবের লাম্পট্যের বিরুদ্ধে লড়াই নেই!
অবিবাহে-বিবাহের পুনঃপৌনকিতায় শিব জড়িয়েছেন প্রফেটাইজ কবি যিশু মুহাম্মদে
তিনি যাচ্ছেন কুম্ভমেলায়; নাঙ্গাসাধুর ঘামের ঘ্রাণেই মোদিজির
আতর কারখানার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে রিলায়েন্স! গুজরাট ছড়িয়ে পড়ছে
কানেকটিকাটে। উন্মাদ তরুণের মুহুর্মুহু গুলিতে নিউটাউন স্কুলের
অর্ধশত শিশু নিহত। ওবামা গেছেন সান্ত্বনার মণ্ডা নিয়ে। পাশেই গুজরাটি
গ্রোসারিতে গান্ধীজির নিকুচি করছেন মোদির বেনিয়া সাঙ্গত। অহিংসার
পক্ষ নিলে হিংস্রভাবে আমার মুসলমানিত্বে আঘাত দিলেন। সেদিন খৎনা
শিশ্নের শিরদাঁড়া কেঁপে কেঁপে উঠলে ড্যানভারি যুদ্ধের গাজী হয়ে সিরিয়ায়
হিজরত করতাম। আইসিস ভাইদের গনিমতে ঝাল মিটত লাফাঙ্গা শিশ্নের।
আহা আইডেন্টিটি!

দেশকে ভালোবসি; তবু দেশগুলো সব উগ্র স্বাদেশিক।
গ্রামকে ভালোবাসি; তবু গ্রামান্ধ মারামারি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে।
ধর্মকে ভালোবাসি; তথাপি ধর্মান্ধ হিংস্র নখর মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে চলেছে
এ শতাব্দীতেও! দলকে ভালোবাসি; তবু আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্বের অন্তর্ঘাত বধ
করে রাজনীতির মূলমন্ত্র। মানুষকে ভালোবাসি; যদিও মানবিক হিংস্রতা আর
অহং ভড়ংয়ের ‘পাশবিক’ গালিতে লজ্জা পাই। পৃথিবীকে ভালোবাসি;
তিনিও ছায়াপথ-চ্যুতিতে চুর্ণ বিচুর্ণ মানুষের ইমারতের মণ্ড নিয়ে পৌঁছে যাবেন
কৃষ্ণগহব্বরে।

কেয়ামত সে কেয়ামত!
তুমিই আমার সাধনভজন প্রিয়,
চলো নৌকায় উঠি, নুহের নৌকা বাঁধা রাখা ঘাটে।

মুহূর্ত

মুহূর্তবাদী হতে হলে মুহূর্তকে কামড়ে কামড়ে আস্বাদন নিতে হবে।
খেতে হবে মুহূর্তের নীল গরল কামড়!
ভাবো, মুহূর্তের জন্য বাঁঁচছো তুমি। এরপর হয়তো কিছু থাকবে না;
কোনো কল্পিত স্বর্গ কি নরক। নীল সাগরের কুয়াশা মিলিয়ে যাবে দিগন্তে।
ভাবো, মানুষের প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগার ভেঙে দেবে মনোবিজ্ঞানের
কোনো আবিষ্কার। লোভ, ঘৃণা, হিংসা থাকবে না কোথাও। ভেদাভেদ
থাকবে না ধর্ম,বর্ণ, ভাষা, পেশা, ধনী, গরিব, উচ্চ, নীচ কোনো কিছুরই।
সম্পত্তি-লিপ্সা, ক্ষমতানুরাগ, খ্যাতিলিপ্সা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুই থাকবে না।
পরিচয়ের হিংসা থেকে, জীবনের ক্ষুধা থেকে খাদ্য আহরণে অপরাপর
প্রাণী ও উদ্ভিদের অনিবার্য হত্যার পাপ থেকে নিস্তার পাবে মানুষ। ভাবো;
যা ঈশ্বরও ভাবেনি, সে মুহূর্তটির কল্পনা কত সুন্দর! ভাবো প্রিয়তম
তুমি আমার চেয়েও অনেক বেশি পৃথিবীর ছিলে!

তোমার অনুভুতিগুলি দিয়ে তালপিঠা, ঝালপিঠা আর ফ্রুট কেক বানিয়ে
খেয়ে ফেলতে পারি। তোমার নিশানাকে নিশিন্দা তিতার মতো লাগছে!
পৃথিবীর নিশীথে মুহূর্ত থেমে গেলে একটা কালো শূন্যতার গর্তে পড়ে যাবে
তুমিও! এত বৃষ্টি এই অন্ধকারে অনেক জীবনের শব্দ এখানে বৃষ্টির মতো
পড়ে যাচ্ছে, স্রোত হয়ে ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রে।
পৃথিবীর সূর্যকে কোন কক্ষপথে পাঠালে ভিন্ন ছায়াপথের সূর্যদের সাথে
হলুদ প্রেমের ঘষাঘষি করবে না! হে সূর্য, জ্বলে যাচ্ছো তুমি।
জ্বালিয়ে যাচ্ছো লোকালয়, বিরাণ প্রান্তর। তোমার তেজ আরেকটু
বাড়িয়ে এন্টার্কটিকা, হিমালয় আর আল্পস গলিয়ে সব নদীকে এক করে
সব সমুদ্রকে এক করে একক জলজ পৃথিবী বানিয়ে থৈ থৈ ঢেউয়ে
ঢেউয়ে সব প্রাণীদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারো; অনন্ত নির্বাণের ঘুম।

ডেড সি’র মতো একটা একক মৃত সাগর পড়ে থাকবে পৃথিবী হয়ে!
একটা পৃথিবীময় বজ্রপাতের আলো দিনের আলোর চেয়েও বেশি
আলো দিতে পারে। ভিন্ন নক্ষত্রের ভিন্ন গ্রহে চলে যেতে পারলে ৩৬০
ডিগ্রি ক্যামেরার সিনেমাটোগ্রাফার হয়ে ছেড়ে আসা একটা ব্যর্থ
খেয়োখেয়ি পৃথিবীর সিনেমা বানিয়ে একটা করুণ সুর জড়িয়ে দিতাম!
যে মুহূর্তে এই কল্পনা, স্বপ্ন, উদগ্র প্রত্যাশায় মেতে থাকছি এটিই আমার
সেরা মুহুর্ত। আমি মুহুর্তবাদী।

আমার মতে নিমিষেই শেষ হয়ে যেতে পারে মানুষের সব প্রত্যাশা, চেষ্টা, সব।
অতএব কল্লনা করে হলেও মুহূর্তের জন্য বাঁচো।

বৃক্ষদের কনসার্টে

পৃথিবীই প্রবাসক্ষেত্র। সকলেই
অভিবাসী। অভিযোজনের বেগে বেড়ে উঠি।
হাওয়ার তালে পাল টেনে রাখি। তবুও
প্রবল ঝড়ে উলটে যায় নৌকা। ধানের
সোনালি ক্ষেত ভিজে বেঁকে দোলে..
নদীর কিনারায় সোনালু গাছে ফিঙ্গে
কেঁপে যায়। আহা শীত! আষাঢ়ের ভিজে
বিকেলের টুপটুপ ঝরে পড়া শীত।

এমন ঘটনাও ঘটে যাবে; পুরাঘটিত
কালের ইতিহাসে, যাইতেছির কালে
প্রবাহিত বাতাসের স্রোতে হৈ হৈ
আনন্দরবে তুমিরাও ছিলে। চরমপুলকের
ঘোরে অপার্থিব স্বর্গকে ডেকে আনি
সমাজের সংসদে। ধর্মঘোরের শব্দরে
সংগীতে নামাই। হু হু বাতাস বইছে
হাওয়ার রাতে। ঝিলপাড়ের বৃক্ষদের
কর্নসাট বসিয়ে দিই এক্সপেরিমেন্টাল
কিংবা ক্লাসিকাল ড্যান্স-ফেস্টে।

সেখানে পাতা-প্রপাতাদের নৃত্যমুদ্রার
পুরস্কারে মোহর তুলে দেবেন
বিশেষ অতিথি আবুল মাল!

এতসব ইনভিজিবল সিনেমাটোগ্রাফির
রেকর্ড বর্জ্যে ব্ল্যাকহোল ভরে গেলে
নতুন গ্রহ নক্ষত্রের সিনেমার কাজে
নেমে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণাকারী
আমিই আগামী পার্লামেন্টে স্বতন্ত্র
প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী।

হঠাৎ শেখ হাসিনা বুঝলেন পরম্পরায়
মহামানবদেরই প্রধানমন্ত্রী হতে হয়!
তিনি তাঁর প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে
আমাকে সমর্থন জানালেন।

পড়ে দেখবেন। ‘আমার ইস্তেহার’
আসছে বাজারে!

প্রধানমন্ত্রীর ট্রাডিশনাল শপথের
সাথে সংগোপন শপথ হবে
‘আমি শপথ করিতেছি যে,
আমি বিশ্বসরকার আর বিশ্বনাগরিক গঠন
আন্দোলনে সারা পৃথিবীকে কমরেড
বানিয়ে তুলব আর পৃথিবীর
নাম দেব মাইগ্রেন্টল্যান্ড।

পরবর্তী শপথানুষ্ঠানে প্যালেস্টাইন, রোহিঙ্গা
আর সিরিয়ানদের সাথে হুগো, টুটসি,
জিউস, সাঁওতালি, মুরংদেরদের
মার্চপাস্টে আমাকে অভিবাদন জানাবে
রাশান, চাইনিজ, ব্রিটিশ, আমেরিকান
কিংবা জানাতে বাধ্য হবে নব্য আর্যরাও।
আই হ্যাভ এ ড্রিম, আই হেভ অডাসিটি!
প্লিজ ভোট ফর মি...

গাছগুলো সব রাগি চোখে তাকিয়ে আছে

হও, হয়ে যাও। গাও, গেয়ে ওঠো। হাসো উল্লাস করো। কড়া তামাকের
মিষ্টি ঘোর নাও হেসে ওঠো।

জ্যাক, ড্যানিয়েলকেও আসতে বলো। মার্গারিটার ককটেল পাওয়া গেলে
নিউজক্যাফের সংবাদ নিউজ হয়ে যায়। কফি হাউজে ধর্মঘট, কাটলেট
আর ফিস ফিঙ্গারের দাম দু টাকা বেড়েছে। ওয়েস্টগেটে বোমাহামলায়
দুজন ইন্ডিয়ান কেনিয়ান নিহত গাছগুলো সব রাগী চোখে তাকিয়ে আছে
মানুষগুলোর কামড়াকামড়ি আর পিঁপড়েমি একইরকম লাগছে।

সে দাঁড়িয়ে থাকে স্থির। কে যেন তাকে ভাবাচ্ছে তার শাখা-প্রশাখায়
পাতা-প্রপাতায় নৃতকম্পনের দোলা যৌনসাফল্যের স্বপ্ন তারও আছে।
নিন্দার কামিনী, নন্দনে নরম হয়ে ঘ্রাণের গভীর চেতনাটি দিয়ে যায়
মগজে। তোমার সমস্ত দ্যুতির আলোয় মাখামাখি হয়ে হাঁড়িয়া নাচন
দিই চা বাগানের হোলিতে।
ভালোবাসি।
তোমার লম্পঝম্প কোলে ওঠা শৃঙ্গারের অভিনয় কিংবা গভীর গোপন
মমতা দেখে ফ্যালে আকাশমণি। বৃক্ষতলে থাকা না থাকা সাপেদের ভয়ে
ভাই ভাই বলে হাঁক দিলে চুদিয়াপাতা ফণা তুলে লজ্জাবতীর বাগানে
হামলা করে। দশজন মল্লিকবংশীয় লজ্জা নিহত হন। সংঘর্ষ ছড়িয়ে
পড়লে ইমানুয়েল ম্যাক্রোকে ফোন দেয় জাস্টিন ট্রুডো।

লজ্জা চৌধুরী বংশের অধিকারের বিল পাশ করে ওবামা প্রশাসন। ওদিকে
সুন্দরবন আন্দোলনের নেতারা লজ্জা বংশের লজ্জাকে রোগ বলে ফতোয়া
দ্যায়। বনের ভারসাম্য নষ্টের অপরাধে ফরহাদ মজহার রক্তাত্ব সংগ্রামের
ডাক দিলে ওহাবিয়া বংশের সব কুড়াল, গ্রেনেড, ককটেল ক্ষেপে ওঠে
৫৩ জেলার বিস্ফোরণে মতিঝিল কেঁপে ওঠে
পুড়ে যায়, ফলত লুই আইকানের অনিন্দ্যসুন্দর বাস্টার্ড চাইল্ড একা হয়ে যায়!

‘মাই আর্কিটেক্ট’
উত্তরপাড়ায় ক্যাপিটাল চলে গেল!

তবুও; যা তাই হও, গাও, হাসো, উল্লাস করো
ভিজিবল, ইনভিজিবল সব মৌল-মিলিটারি শাসন ধ্বসে যাবে কালে।

সবকিছু বোঝা যাচ্ছে

চারদিক থেকে শব্দ আসছে নগরের বারান্দায়। কানকুহরের পথে মগজ কাঁপানো
ঝিরঝির। কথা বলে যাচ্ছে সবাই, গেয়ে যাচ্ছে সবাই; মানুষ, বৃক্ষ, কীটপতঙ্গ সবাই।
শব্দকে বাক্য বানিয়ে সুরেলা হাওয়ার তালে কারা যে কোরাস গায়! একটা গভীর
স্তরে যেয়ে ভাবা যায়; তুমি কে? আমি কে? একটা অন্যরকম বাস্তব পৃথিবীতে
আমাদের লেনদেন।

তাই, ‘হাতে নাইরে কড়াকড়ি’ গায় তারা। সবকিছু বুঝে ফেলি আমি; বুঝতেও কষ্ট
হয় মাঝেমাঝে। হাসাহাসির চিলেকোঠা ছেড়ে গম্ভীর হয়ে চলে যাওয়া যায় বাহিরের
পৃথিবীতে। সেখানেও অনেক বৃক্ষদের দাঁড়িয়ে থাকায়, অনেক পিঁপড়েদের চলাচলে
অনেক মশাদের ওড়াউড়িতে আছে হাসাহাসি, বিরহ রোদন।

যদিও পৃথিবীর গতির মতো নয় কারো গতি। সবকিছু এত ধীরভাবে চলে। ধীর হয়ে
গেলে তাড়াহুড়ো থাকে না। দোকানি সিগারেট না দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রাখলেও
রাগ লাগে না। একটা পাঁচশো সত্তর সাবান চাচ্ছে লোকটা ৪৩ বছর ধরে!

একজন জাতির পিতার শোক বয়ে বেড়াচ্ছে একজন দিনমজুর। ভিক্ষুক রমিজার
স্বামী হাসমত আলীও বঙ্গবন্ধু কন্যার নামে জমি কিনে মরে যায়!
এখনো উদাসীন মানুষেরা হাওয়ায় পুরনো প্রেমিকার প্রেত হয়ে ওড়া দেখে হাসে
রমেশের মতো। রমেশের ভালোবাসার বৃক্ষটি তার জন্য কাঁদে, মানুষের জন্য কাঁদে।
আর বাকি মানুষেরা বৃক্ষটিকে কেটে নিয়ে করাতে দেবে একদিন! কার ঘরের
আসবাব হবে সে কে জানে! আসবাবকে কেউ কি ভালোবাসে প্রেমিকার মতো?

শুনেছি, একটা ট্রাককে ভালোবাসে একজন কবি। ট্রাক দেখলেই নাকি তার শিশ্ন
উত্থিত হয়! বটগাছ দেখলেই আরেকজনের বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে ঘোরপ্রেম আসে।
পৃথিবীর মানুষেরা তাদের অন্ধরাহুর মতো ভাবে। কোনো নর নরকেও ভালোবাসে
কোনো নারী নারীকে। কোনো ক্লীব সমান্তরাল জীবনের ক্লেদ নিয়ে ইশ্বরকে ছুঁড়ে
দ্যায় প্রশ্নবাণ!

তবু তারা তো এরকমই! প্রচল ভাবনার বাইরের মানুষেরা, প্রাণীরা, বৃক্ষেরাও বেঁচে
বেঁচে মরে যায়! চর-ভৈরবী ঘাটে কত কত ইলিশ শেষ কান্না কেঁদে মরে গেছে, দেখেছি।
পৃথিবীর কোন গুদারাঘাটে, কোন বন্দরে যাচ্ছো তুমি? এডেন, মোম্বাসা, হেরাক্লিয়ন
না আলেকজান্দ্রিয়ায়? সবাই সবার মতো জীবন চালিয়ে যাচ্ছে, তবু সবাই সবাইকে
টিটকারি দিচ্ছে! যুগ যুগ ধরে এরকমই চিরায়ত জীবন!

পৃথিবী একটা মহাশূন্য-যানের মতো প্রবল গতিতে ভেসে যাচ্ছে। প্রতিদিন একবার
প্রদক্ষিণ করছে সে সূর্যকে। একটা বিশাল গোল মহাশূন্য-যান উড়ছে; যার চতুর্দিকে
মানুষ অন্যান্য প্রাণীকুল ও তৃণ-বৃক্ষেরা।

এত গতির মধ্যে মানুষেরাও নিজস্ব গতিতে কিলবিল করে কেঁচোদের মতো।
জানে না কেঁচোরাও গান করে নেচেনেচে তাদের সংসারে। কি সুন্দর পৃথিবী!
অদৃশ্য চিত্রগ্রাহক হয়ে তুমি এর সব মুহূর্ত রেকর্ড করে রাখতে পারো৷ মুহূর্ত
এগিয়ে যাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। মানুষের মনে কত কত মুহূর্ত গেঁথে যাচ্ছে। পৃথিবীর
গঞ্জগুলো অনেক বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে শহর থেকে নগর মহানগর হয়ে
গেছে, যাচ্ছে, চারদিক থেকে শব্দ আসছে।

   

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;