ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১২

  • মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

[দ্বাদশ কিস্তি]

টমাস আর পল্লবীর অপ্রাণ চেষ্টায় অতিদ্রুত ম্যারির আর্ট একজিবিশন শুরু করা সম্ভব হলো। ছেলেমেয়ে দুটির আবেগ ও উৎসাহের টানে ম্যারি অনীহা বজায় রাখতে পারলেন না। দীর্ঘদিনের আড়াল ছেড়ে তিনি ছবিগুলো নিয়ে প্রকাশ্য প্রদর্শনীতে হাজির হলেন।

বিজ্ঞাপন

চমৎকার একটি ব্রুশিয়র তৈরি করা হয়েছে প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে। ম্যারির সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ছবিগুলোর বিবরণ স্থান পেয়েছে তাতে। প্রদর্শনী গ্যালারিতে নান্দনিক আলোর বিন্যাসে ডিসপ্লে করা হয়েছে ছবিগুলো। আয়োজনের সবকিছু দেখে মুগ্ধ ম্যারি। একটা অজানা ভালো লাগায় তাঁর চোখে চোখে জল চলে এলো। কিছুক্ষণের জন্য তিনি সবার অলক্ষ্যে একটি নিভৃত কোণে চলে এলেন।

ম্যারি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে পুরো প্রদর্শনী হল দেখা যাচ্ছে। তাঁর ছবিগুলোও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছেন তিনি। একে একে নিজের সৃষ্টিকর্মগুলো নিরীক্ষণ করতে করতে তন্ময় হয়ে গেলেন ম্যারি। ঠিক তখনই তার মনে হলো, আহা, ক্যাভিন যদি এখন পাশে থাকতো?

বিজ্ঞাপন

ক্যাভিন সব সময়ই চাইতো ম্যারি যেন ছবি আঁকায় মেতে থাকে। নিয়মিত ছবিগুলোর প্রদর্শনী করে। ম্যারির জীবনে ও সৃজনে ক্যাভিন এক সতত অনুপ্রেরণার নাম। সহযোগিতা ছাড়া আর কিছুই দেয় নি ক্যাভিন। হঠাৎ চলে যাওয়ার ঘটনাটি ছাড়া ম্যারিকে আর কোনও কষ্ট ক্যাভিন দেয় নি।

নিজের ছবিগুলোকে কি ক্যাভিনের ছায়া রয়েছে? ম্যারি মনে মনে প্রশ্ন করে নিজেকে। ম্যারি জানেন, বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্রপূর্ণ রেখার চরিত্রকে নিয়ে তাঁর নিরলস নির্মাণের পিছনে রয়ে গিয়েছে অতীত সময়ের ঐতিহ্য ও স্মৃতি, যা ছাত্রাবস্থার শুরুতে একটি শক্তপোক্ত ভিত তৈরি করে দিয়েছিল ক্যাভিনের সান্নিধ্য।

ক্যাভিনের সঙ্গে যাপিত জীবনের প্রতিটি অংশ যেন ম্যারির শিল্পশিক্ষার প্রতিটি বাঁক ও গতিপথকে নির্দেশে করছে নীরবে। যেন আজীবন পাথেয় হয়ে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে ঠিক পাশেই। হয়ত এজন্যই ম্যারি একাকীত্বের অশক্ত মন নিয়েও নিবিড় শিল্পের অধ্যবসায়ে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। জীবনের ছাপচিত্রে অঙ্কিত ঐতিহ্যকে তাঁর কাজে দীর্ঘকাল ধরে সন্তর্পণে বহন করে চলেছেন ম্যারি।

ভাবনার চেয়েও বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ম্যারির প্রদর্শনী। শিল্পকলার সঙ্গে জড়িত মানুষদের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষকদের একটি বড় অংশ চলে এসেছেন আন্তরিক আগ্রহে। ম্যারি আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, প্রদর্শনীর বিক্রয়লব্ধ অর্থ তিনি বিশ্বের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে দান করবেন। এতে প্রদর্শনীর আলাদা গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। মিডিয়াতেও বিষয়টি আলোচিত হয়। সব মিলিয়ে জমজমাট আবহ সৃষ্টি হয় প্রদর্শনী ঘিরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার প্রবীণ শিক্ষক লুসিয়ান উচ্ছ্বসিত ভাষায় ম্যারির ছবিগুলো প্রশংসা করে বলেন, "তাঁর চিত্রে রেখাগুলোর কাব্যিক, লাবণ্যময়, সুষমামণ্ডিত টানটোনের রিয়্যালিজ়ম মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে। মাধ্যম বদলে যখন পেনসিল, ড্রাই বা অয়েল প্যাস্টেল, কন্টি, চারকোল, পেন-ইঙ্ক, তুলিতে চলে যান, রেখার ভিন্নতা ও চরিত্র বদলেই যায় না শুধু, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেক্সচার, ভলিউম, স্পেস ও ব্যালান্স এগুলিও কম্পোজ়িশনের ওতপ্রোত অংশ হয়ে ওঠে। তিনি বর্ণকেও অনুরূপ ভাবে তার ঘনত্ব ও তারল্য, মেদুর ও প্রায় বিবর্ণ, একটি সামান্যতম আভাস রাখা ছায়াতপকেও রচনার সঙ্গে একাত্ম করে দেন। এমন শৈল্পিক কুশলতা বিরল গুণ।"

ম্যারি তাঁর বিগত ২৫ বছরের ১০০টি কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর  শিরোনাম দেন ‘ইন সার্চ অব বিউটি’। মূলত ছবিগুলো সবই ড্রয়িং, ড্রয়িং-বেসড পেন্টিং। বর্ণ পটভূমিতে যতটা অংশ জুড়ে তার ঘনত্ব ও ঔজ্জ্বল্যকে জানান দিচ্ছে, সেখানে অবয়বী রূপ-রেখার আশ্চর্য সৌন্দর্যে আলাদা একটি গঠন তৈরি করে বর্ণ-বৈপরীত্যের ছন্দোময় অবস্থাটিকে প্রত্যক্ষ করায়। ম্যারির ছবিতে এসেছে তাৎক্ষণিক মুহূর্তের টুকরো ঘটনা। যেমন নিবিড় সান্নিধ্য, অপেক্ষা, সঙ্গীত, কথোপকথন, স্নেহ, বাৎসল্য, সাজসজ্জা, দেবদেবী, বিশ্রাম, প্রণয়, রংধনু ও অন্যান্য।

সমগ্র স্টাইলে রেখার ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের অনুসন্ধান করেছেন ম্যারি। রূপবন্ধ ও অবয়বকে স্থান দিচ্ছেন নানা ভাবে, সেখানে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বর্ণের সাযুজ্য ও টোন, এমনকি ঔজ্জ্বল্য ও অতি হালকা একটি আভাসকে প্রশ্রয় দিয়েছেন ওই বিশেষ জায়গাগুলোতে। আবার অনেকটা স্পেস রেখে শূন্যতাকে যৎসামান্য রেখার সঙ্গে মানানসই করে, রূপের মধ্যে বর্ণহীন এক কবিতাই রচনা করেছেন যেন! রেখার বিস্তার ও ছন্দোময় অধ্যায় যেন পটভূমি থেকে বেরিয়ে আসছে দর্শকের দিকে। এই অসাধারণ অনুভূতি কিন্তু বর্ণ ও রেখা, বিশেষত কম্পোজ়িশনের চমৎকারিত্বের বিশেষ একটি দিক।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রদর্শনী এমন রিভিউ মনোযোগ দিয়ে পড়েন ম্যারি। অধিকাংশ বোদ্ধা ও শিল্প-নন্দনের বিশেষজ্ঞ লিখেছেন যে, ম্যারির কাজগুলো পর্যালোচনা করলে একটা প্রধান কাঠামোর সন্ধান পাওয়া যায়। যার মধ্যে নিজস্ব সৃষ্টির একটি সরগম আছে, প্রাথমিক শর্তের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে অনন্য সুরের অনুরণন। সেই সব রেখা থেকেই কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে সুর, মিশে যাচ্ছে বিভিন্ন বর্ণের শরীরে, শূন্য স্পেসেও।

ম্যারি ছবিতে রেখা ব্যবহার করেছেন চিকণ, সূক্ষ্মতর, সরু, স্থূল, মন্থর, সরল, চলনের বৈশিষ্ট্যে কখনও তা দ্রুত ও নিরীহ। সবই ম্যারির স্টাইলের ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে।

আলোচনা-সমালোচনাগুলো পড়ে ম্যারি অনুপ্রাণিত বোধ করেন। তাঁর নীরব শিল্পচর্চা যে ব্যর্থ হয়নি, সবার নজর কেড়েছে, তাতেই তিনি খুশি। ভালো লাগার মধ্যেও তিনি মনে মনে একটি অতৃপ্তিকর ভাব টের পান। যদি ক্যাভিন প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকতো এবং ছবিগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করতো, তার খুবই ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। স্বেচ্ছায় যে আলাদা পথে চলে গেছে, তাকে কোথায় খুঁজে পাবে ম্যারি!

জীবনের ঘাটে ঘাটে ঠেকতে ঠেকতে ম্যারি বুঝেছেন, মানুষ অতীত স্মৃতি নিয়ে নয়, বাঁচে বর্তমান নিয়ে। টমাস, পল্লবী এরাই এখন তাঁর বেঁচে থাকার আনন্দ ও অবলম্বন। অতীত মাঝে মধ্যে হয়তো হানা দেবে। কিন্তু বেঁচে থাকতে হবে বাস্তবের চলমানতাকে নিয়েই। ম্যারি তাই নিজের সঙ্গে বার বার লড়াই করে বর্তমানের জমিনে ফিরে আসেন। প্রশংসা, বাহবা ইত্যাদির পাশাপাশি তাঁর প্রদর্শনীর আর্থিক লাভও কম হয় নি। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ছবি বিক্রি হওয়ায় একটা বিশাল অঙ্কের টাকা তাঁর হাতে এসেছে। টাকাগুলো শরণার্থী শিবিরের শিশুর জন্য ঠিকমতো পৌঁছানোর ব্যাপারে টমাস ও পল্লবীকে দায়িত্ব দিলেন তিনি। সম্ভব হলে ওদেরকে সশরীরে কোনও রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে টাকার বিলি-বণ্টন করতে বললেন তিনি। ওরা সানন্দে রাজি হলো। ম্যারি এখন তাঁর স্বপ্নের আর্ট ভিলেজ গড়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেবেন বলে ঠিক করলেন। শিল্পের মধ্যে বেঁচে থাকতে তাঁকে একটি শিল্প ভুবন গড়তেই হবে।

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১১