ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১১

  • মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

[একাদশ কিস্তি]

একদিন আচানক পল্লবী অসময়ে রং-পেনসিল নিয়ে হাজির। সঙ্গে আরও কিছু বই। ম্যারি অবাক হলেও কিছু বললেন না। হাসি মুখে ডেকে নিলেন মেয়েটিকে। বইপত্রগুলো পাশের একটি টেবিলে রেখে পল্লবী সাফ জানিয়ে দিল:

বিজ্ঞাপন

“এখন থেকে সময় পেলেই আমি তোমার কাছে চলে আসবো। আঁকা শিখবো তোমার কাছে। টমাস থাকলে ওর সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করবো।”

“তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমি খালি বাসায় তোমার সঙ্গ পাবো।”

বিজ্ঞাপন

কথাটা বললেও মনে মনে ম্যারি চিন্তিত হলেন। ক্যাম্পাসের নিয়মে শিক্ষার্থীরা কালে-ভদ্রে, আচার-অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বাড়ি আসে বটে। নিয়মিত আসা-যাওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। পল্লবী যেভাবে প্রায়-ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে উঠছে, তা কারো নজর এড়াবে না। ম্যারি ভাবেন, পাছে কিনা এসব নিয়ে কথাবার্তা হয়। তিনি লোকজনের নিন্দামন্দ ও পেছনের কথা বলা খুবই অপছন্দ করেন। তিনি শান্তিতে ও চুপচাপ নিজের কাজ নিয়ে থাকতে চান।

এইসব দুশ্চিন্তা মনে এলেও পল্লবীকে তিনি না বলতে পারবেন না। কেমন আপন হয়ে মেয়েটি তার সঙ্গে মিশছে, পরিবারের অংশ হচ্ছে, এই আবেগ ও ভালোবাসার মূল্য অনেক। তিনি দেখতে পেলেন, পল্লবী পেনসিলের টানে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। ম্যারি তাকিয়ে রয়েছে দেখে পল্লবী বলল,

“এখন থেকে আমি শুধু তোমার কাছেই পড়ব। ক্লাসের বাইরের সময়গুলো তোমার সঙ্গে কাটাবো”

পল্লবীর গলায় কিছু ছিল, ম্যারি অবাক চোখে দূরদেশের মেয়েটির দিকে চেয়ে রইলেন। পল্লবী খাতায় একটা দাগ টানা শেষ করে নিরুত্তাপ গলায় বলল,

“অফিসের পর তুমি তো বাড়িতেই থাকো সারাক্ষণ। লেখালেখি ও পড়াশোনা করো। আমিও ক্লাশ শেষে চলে আসবো তোমাকে সাহায্য করতে। শুধু খাওয়া আর রাতের ঘুমটুকুর জন্য হোস্টেলে যাবো।”

“সে দেখা যাবে। কিন্তু হোস্টেলে বেশিক্ষণ থাকতে তোমার ভালো লাগে না? সেখানে তো অনেক মেয়ে থাকে।”

“তা থাকে। তবে, ওরা আলাপ ও হট্টগোল বেশি করে। আমার ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে তোমার সঙ্গে থাকতে। নানা কাজে ডুব দিতে। আমি অনেক কিছু পড়তে চাই, করতে চাই।”

ম্যারি টের পেলেন, পল্লবী তাকে বিশেষভাবে খেয়াল করছে। ওর কাজকর্ম, রুটিন, সবই তার জানা। তিনি যে অফিসের পরেও সপ্তাহে একদিন বাড়িতে কতগুলো ছেলেমেয়েকে আঁকাজোকা শেখান, এখনও মাঝে-মাঝে নিজের ছবির নিয়ে মেতে থাকেন, সেসব পল্লবী ফলো করেছে। চিন্তিত হয়ে রাতে তিনি টমাসকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে।

“পল্লবী মেয়েটি কেমন মনে হয় তোমার। ও আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়।”

“ভালোই তো। ও এলে অসুবিধা কি? তুমি বাসায় না থাকলেও তো সে এসে আমার সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে আলাপ করে যায়। পল্লবী বলেছে, ওর দেশে তোমার ছবির প্রদর্শনী করবে। ”

ম্যারি কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে নড়ে উঠলেন। তার ও টমাসের সঙ্গে যে প্রবল আগ্রহ নিয়ে মেয়েটি মিশতে চাচ্ছে, সেটাই ম্যারির কাছে আশঙ্কার বিষয়। ওদের বয়স কম। কোনও অঘটন হলে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। এই আশঙ্কা তাকে বিব্রত করে।

সে রাতে এক ফোঁটা ঘুম হল না ম্যারির। পল্লবী ও টমাসের যা বয়স তা স্পর্শকাতর। কখন কি করে বসবে, ঠিক নেই। পল্লবীর দেশে তার ছবির প্রদর্শনী করার কথা ভাবতেই সব দুশ্চিন্তা ভেসে যায়। কিন্তু তিনি স্বস্তি পান না। তার জীবনের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। তিনি জানেন, মানুষ ভাবে বা পরিকল্পনা করে এক রকম আর ঘটে যায় অন্য রকম। ভাগ্যের কারণে কিংবা নিজের আবেগকে সামলাতে না পারার কারণে এমন অনেক কিছুই করা হয়, যেগুলোকে পরে মনে হয় হটকারিতা।

সারা রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও মনস্থির করতে পারলেন না ম্যারি। অস্থিরতা আরও বাড়ল, যখন পরদিনই পল্লবী এসে কথায়-কথায় জানাল, আজ সন্ধেবেলা তারা সবাই আর্ট মিউজ়িয়াম যাবে। ম্যারির ছবির এগজ়িবিশন করার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবে। এসব শুনে তিনি বেশ অস্থির বোধ করেন। এতো আবেগ, এতো টান কেন মেয়েটির? ক্যাভিনও তার জন্য কিছু করতে পাগলের মতো হয়ে যেতো। কাজটি শেষ না করা পর্যন্ত শান্ত হতো না। পল্লবী নামের মেয়েটিও এমন পাগলামি করছে কেন!

আঁকার কাজ চালিয়ে গেলেও ম্যারি এগজিবিশন করার কথা মোটেও ভাবেন নি। তাছাড়া অনেক বছর মিউজিয়াম বা আর্ট গ্যালারিতে যান না এগজিবিশন দেখতে। বিকেলবেলা ওরা তিন জন রওনা দেওয়ার আগে ম্যারি অনেক দিন পর নীচতলায় নেমে এলেন। মনের মধ্যে অশান্তির ঝোড়ো হাওয়া বইছে কাল রাত থেকে। অনিশ্চিত পদক্ষেপে কী মনে হতে হালকা ঠেলা দিতেই একটি বিশেষ ঘরের দরজাটা খুলে গেল। পুরনো অভ্যেসে অন্ধকারেও আপনা থেকেই ম্যারির হাত চলে গেল সুইচ বোর্ডের গায়ে, আঙুলের ছোঁয়ায় ঘরে জ্বলে উঠল জোরালো বৈদ্যুতিক আলো। ক্যাভিন চলে যাওয়ার আগে এ ঘরটায় তাঁরাই থাকতেন। ম্যারি নিজের হাতে সাজিয়েছিলেন ঘর, তাঁর পছন্দের আসবাব এনে পেতেছিল। আজও ঘরটার সজ্জা একই রকম আছে। পুরনোগুলোর পাশে জায়গা করতে পারেনি নতুন আসবাব। কিন্তু স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেওয়া আসবাবের দিক থেকে ম্যারির চোখ জোর করে টেনে নিল ঘরের দেওয়াল। ম্যারি আজ প্রথম বার দেখলেন, চার দেওয়ালে ঝলমল করছে তাঁর আঁকা বড় বড় মাপের পেন্টিং। তিনি ভীষণ অবাক হলেন। এই ছবি তো এখানে ছিল না। তবে কি টমাস বা পল্লবী এখানে নিয়ে এসে ঝুঁলিয়েছে।

কতক্ষণ সেই ঘরে বন্দি হয়ে ছিলেন মনে করতে পারেন না ম্যারি। অনেকক্ষণ পরে ঘরের আলো নিভিয়ে দরজাটা টেনে উপরতলায় ফিরে এলেন। তারপর ম্যারি চুপচাপ সবার সঙ্গে এগজ়িবিশন ঘুরে এলেন। বেশ কিছু বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণও করলেন। আজকালের ছবি আঁকার স্টাইল। প্রদর্শনীর ডিসপ্লের ধরণ। সব দিকে নজর দিলেন তিনি। ম্যারির মনে হলো, তিনি আঁকার বিষয়ে নতুন করে প্রণোদনা পাচ্ছেন পল্লবী ও টমাসের কাছ থেকে।

পরদিন সকালে লাইব্রেরির অফিসে যাওয়ার আগে একবার ম্যারি ব্যাঙ্কে গেলেন আর দুপুরবেলা যখন আর্ট গ্যালারির চত্বর খাঁ খাঁ করছে প্রায়, কাউকে কিছু না-জানিয়ে আরেকবার ঢুঁ মেরে এলেন সেখানেও। তাঁর মনে পড়লো, ক্যাভিনের বন্ধু মার্ক আর তার স্ত্রী রেবেকা সদ্য একটা আর্টস ভিলেজ তৈরি করছে ক্যাম্পাসের কাছেই একটি খোলামেলা জায়গা নিয়ে। নবীন শিল্পীরা সেখানে আবাসিক ক্যাম্প করে আঁকার প্রশিক্ষণ নেয়, নিজেদের বিকাশ ঘটায়। ফোনে রেবেকার সঙ্গে সামনের উইক অ্যান্ডে সারাদিন সেখানে কাটানোর পরিকল্পনা পাকা করলেন তিনি। রেবেকাকে জানালে যে, তরুণ শিল্পীদের একগুচ্ছ ছবি তিনি কিনতে চান। তবে ম্যারির শর্ত, ক্রেতা হিসাবে তার নাম জানানো যাবে না। রেবেকা হাসতে হাসতে রাজি হলো। বোঝা গেল ক্রেতার নাম উহ্য রাখার অনুরোধ গ্যালারি মালিকদের কাছে নতুন নয়। রেবেকা সানন্দে রাজি হলেন।

রাতে বাড়ি ফিরে ম্যারির মনে হলো জীবনের আরেকটি নতুন বাঁকের দিকে তিনি এগিয়ে চলেছেন। আগে যেমন সঙ্গে ছিল ক্যাভিন, এখন সঙ্গে আছে টমাস ও পল্লবী। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিনি এসব নিয়ে অনেক ভাবলেন। তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক, একটি আর্টস ভিলেজ বা আর্ট গ্যালারি করবেনই। জীবনের সবটুকু দিয়ে তিনি তার কাজের চিহ্ন ও স্মৃতি রেখে যেতে সর্বশক্তি ঢেলে দেবেন। গভীর রাতের দিকে ঘুমে ঢলে পড়ার আগে ম্যারি একবার ক্যাভিনের মুখচ্ছবি কল্পনা করলেন। তাঁর চোখের কোণ ভিজে এলো এক চির-উদভ্রান্ত ক্যাভিনের চেহারা দেখে।

অতলান্ত ঘুমের জগতে চলে যাওয়ার আগে আগে কান্না জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে ম্যারি উচ্চারণ করলেন,

“ক্যাভিন তোমাকে আমার চাই না। কোনোদিনও চাই না। আমিও তোমার মতো লেখা আর আঁকা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেবো।”

বুক ফেটে বের হতে উদ্যত তীব্র কান্না থামাতে ম্যারি বালিশে মুখ চেপে রইলেন।

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১০