বুয়েটকাল [কিস্তি ২]



শাকুর মজিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 কিস্তি ১. কেমন করে বুয়েটে গেলাম

মেডিক্যাল হোস্টেলের প্যারাসাইট জীবন 

১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা চলে আসি। বিদেশ থেকে বাবার আনা একটা স্পঞ্জের তোশক  আর একটা বিদেশি লাল রঙের কম্বল ছিল আমার খুব প্রিয়। ১৯৭৮ সালে কালো রঙের যে টিনের বাক্স নিয়ে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলাম সেই ট্রাঙ্কটি প্রায় অক্ষতই ছিল। শুধু তাই নয়, এই ট্রাঙ্কে সাদা রঙ (এনামেল পেইন্ট) দিয়ে নিজের হাতে নিজের যে নাম লিখেছিলাম, সেই নামটিও প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। সেই ট্রাঙ্কের ভেতর আমার সমূহ সম্পত্তি, মানে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার কাটিং স্ক্রেপ বুক, নানা রকমের লিটিল ম্যাগাজিন, কিছু ফটোগ্রাফ, দুই জোড়া জুতা, স্যান্ডেল, কাপড়-চোপড় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য চলে আসি। এসে উঠি মহাখালীতে আমার বাবার এক চাচার বাসায়। এসে বলি, কাল পরশুর মধ্যে আমার হলের সিট হয়ে যাবে, চলে যাব। কিন্তু আমি তো জানি কাল-পরশুর মধ্যে আমার সিট কী করে হয়! অফিসিয়ালি ক্লাস শুরু হতে আরো দুইমাস বাকি। আমি শুনেছি টিউশনি করে অনেক টাকা কামানো যায়। আমি সেই উদ্দেশ্যে আগাম চলে আসি ঢাকায়।

বাবা মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। বাড়িতে মা আছেন, আর আছে ছোট ছোট ৪ ভাই বোন। আমি সবার বড়। বাবা মারা যাবার পর বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল সে টাকার একটা বড় অংশ নিয়েছেন আমাদের এক আত্মীয়। তিনি এই টাকায় ব্যবসা করছেন। মাকে মাসে মাসে টাকা দেন, তার খরচ চলে যায়। বাকি সামান্য যে কিছু টাকা আছে তা থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে চলে এসেছি ঢাকায়। ঢাকার জীবন শুরু হবে এখান থেকে।

মহাখালী থেকে ৬ নং বাসে হাইকোর্ট, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বকশী বাজারে ডাঃ ফজলে রাব্বী হল।

সেখানে আলাউদ্দিন আছে। ক্যাডেট কলেজে একসাথে ছিলাম ৬ বছর। বেশ কয়েকবার একই রুমেও। শুনেছি এসব হলে ছাত্রদের সাথে থাকা যায়। আমাকে দেখে আলাউদ্দিনের খুব উচ্ছ্বাস । এটা কোনো ব্যাপার হলো! আমাদের থ্রি সিটেট রুম। একটা বিছানা খালিই থাকে। যার জন্য এলোটেড ঢাকায় তার বাসা ঢাকায়, সে মাঝে মাঝে আসে, সমস্যা নাই, তখন আমরা ডাবলিং করব। তুই চলে আয়।

পরদিনই লেপ-তোশক নিয়ে ঢাকা এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বাী হলের ২১ নম্বর রুমে উঠে পড়ি। তাদের ক্লাস শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগেই। এই রুমে আলাউদ্দিনের আরেক রুমমেট আছে, হুমায়ূন। আমি তাকেও খাতির করে চলি। মাঝে মাঝে সিঙারা এনে খাওয়াই। তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, যত তাড়াতাড়ি আমি বিদায় হই, ততই তাদের মঙ্গল। হুমায়ূন আমাকে প্রায়ই জিগ্যেস করে, তোমার সিট হয় নাই ?

আমি মুখে কিছু না বলে, মাথা নাড়াই।

মেডিকেলের হোস্টেলে এ রকম বেশ কিছু বহিরাগত থাকে। ছাত্রদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। এদেরকে বলা হয় প্যারাসাইট। এ রকম আরো প্যারাসাইটের খোঁজ পেলাম ৮ নং রুমে।

ডা. ফজলে রাব্বী ছাত্রাবাসের ৮ নম্বর রুমটা বেশ জটিল। সেখানে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের আমাদের ব্যাচের তিনজন থাকে। তারা জেনুইন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আর দুইজন থাকে প্যারাসাইট। একজন ঝিনাইদহ, আরেকজন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের। প্যারাসাইট-প্যারাসাইট ভাই ভাই, তাদের মধ্যে খুব দ্রুত খাতির হয়ে যায়। এদের দুইজনের সাথেই আমার খাতির হয়ে গেল। একজনের নাম নাদীম। তার সঙ্গে আমার পত্রমিতালী ছিল। ইয়াং অবজারভারের পেন-প্যাল বিভাগে একবার আমার নাম ঠিকানা ছাপিয়েছিলাম। কয়েকটা মেয়ে আর কয়েকটা ছেলে আমাকে চিঠি লিখেছিল। একটা ছেলে লিখেছিল ইংরেজিতে। তার নাম ছিল নাদীম।  সে ইংরেজিতে খুব ভালো। ইংরেজি পত্রিকা পড়ে। তার বিছানায় টাইমস-নিউজ উইক, স্টার ডাস্ট থাকে। আমি মাঝে মাঝে নিয়ে উল্টাই। আর ভাবি, এখানে কী কী আছে যা অনুবাদ করা যায়। কারণ এর মধ্যেই আমি অনুবাদের কিছু কাজ করে কয়েকশো টাকা আয় করে ফেলেছি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ৮ নম্বর কামরার অরিজিনাল বাসিন্দা বাবু। সে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের। বাবুর একটা অটোফোকাস ক্যামেরাও আছে, ইয়াসিকা এমএফটু। চা-সিঙারা খাইয়ে বাবুর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করি। বাবুর ক্যামেরায় টিপ দিলেই ছবি ওঠে। ছবি তুলতে খুবই আনন্দ আমার। হোস্টেলের সামনে আলিয়া মাদ্রাসার গেটের কাছে ভিখিরিদের ছবি তুলি, নিউ মার্কেটে নিয়ে ফিল্ম প্রসেস করি। বি-টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে আসি। ১০ টাকায় পাঁচ কপি প্রিন্ট করা যায়।

একজন একটি টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে। মন্ত্রী মাইদুল ইসলামের বোনকে (নাম সম্ভবত পলি) পড়াই। সপ্তাহে তিন দিন। মাসে ৬০০ টাকা বেতন। টিউশনি শেষে আমার হাতে অনেক সময়, আমি আরো কিছু কাজ চাই।

একসময় বাবু বলে, ‘তুই তো লিখতে পারিস, পত্রিকায় লেখ না, অনেক টাকা পাওয়া যায়।’

পত্রিকায় ছাপার হরফে কেবল লেখা দেখেই তুষ্ট ছিলাম এত দিন। এখন শুনলাম, এখান থেকে টাকাও আসে। বিষয়টি মাথায় চক্কর দিতে থাকে। সিলেটের গ্রাম থেকে ডাকযোগে কয়েকটি লেখা পাঠিয়েছিলাম এক পত্রিকায়, কিছু কবিতা, কিছু গল্প। একটি কবিতা এবং একটি গল্প ছাপা হয়েছে অনেক আগে। তাহলে কি এগুলোর জন্য টাকা পাওয়া যাবে?

অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে হাজির হই টিকাটুলির অভয় দাস লেনের ১৩/বি বাড়িতে। এই বাড়ি থেকে বেরোয় মাসিক রোকসানা। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় সৈয়দা আফসানার, কিন্তু পত্রিকা দেখেন প্রায়বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক। তিনিই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট রোকসানার বাবা। মেয়ের নামে পত্রিকা বের করছেন। তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমই পত্রিকার অফিস।

পত্রিকার একজন লেখক দেখা করতে এসেছেন শুনে তিনি খুবই খুশি। তিনি কোন্ আইসক্রিম আনিয়ে খাওয়ান আমাকে। আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে তাঁর কাছে আমার মনোবাসনা উত্থাপন করি। লেখার জন্য সম্মানী পাওয়া যায় কি না, জানতে চাই।

চশমার ফাঁক দিয়ে তিনি তাকান আমার দিকে। বলেন, কিছু ফিচার, অনুবাদ, এসবের কাজেই তিনি লেখকসম্মানী দেন, যত পৃষ্ঠা ছাপা হবে ততশো টাকা, এটা তাঁর পত্রিকার নিয়ম। জানতে চান, আমি কোন বিষয়ে লিখতে আগ্রহী। বলি, অনুবাদ করতে পারব। দেন।

তিনি প্রথমে একটা রিডার্স ডাইজেস্ট দিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওপর একটা লেখার অনুবাদ করতে বলেন। আমি এই টেক্সটের সাথে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে আরো কিছু জোগাড় করে লিখে দিলাম। তিনি পড়লেন এবং ড্রয়ার থেকে দু’শো টাকা বের করে দিয়ে দিলেন। বললেন, এরকম ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে নিয়ে আসবেন।

আমি নাদীমের সাথে খাতির লাগাই। তার কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য ইংরেজি পত্রিকা নিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার গেটের কাছে ফটোকপি করিয়ে ফেরত দিয়ে দিই। রাত জেগে লেখা অনুবাদ করে  মাসিক রোকসানা পত্রিকার অফিসে চলে যাই।

একদিন সম্পাদক পিতাকে (যিনি সম্পাদিকা তাঁর সাথে দেখা হয়নি। পিতার সাথেই দেখা হতো) বলি, আমি হুমায়ূন আহমেদের একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। করব?

তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

আমি মেডিকেল হোস্টেলে এসে হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই। ফোন করার জন্য বারান্দায় কয়েন বক্সের সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আমাদের মতো প্যারাসাইটদের লাইনে দেখলে হোস্টেলের অরিজিনাল ছাত্ররা বিরক্ত হয়। কিন্তু উপায় নেই। আমাকে ফোন করতে হবে। আমি কয়েকটা সিকি হাতে নিয়ে দাঁড়াই এবং একসময় লাইনের সামনে এসে ফোন ধরার সুযোগ পাই। ফোন করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সচেঞ্জে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ড. হুমায়ূন আহমেদকে চাই। ওপাশ থেকে অপারেটর সংযোগ ঘটিয়ে দেন সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে কার্জন হলে। সেখানে যিনি ফোন ধরলেন, তিনি খুবই দয়াবান এক ভদ্রলোক। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তিনি আমাকে জানালেন, ড. হুমায়ূন আহমেদ এখন তাঁর রুমে নেই, তিনি বাসায় চলে গেছেন। তিনি তাঁর বাসার ফোন নম্বরটি দিয়ে দেন।

সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে আরো দুটি সিকি ঢুকে যায় কয়েন বাক্সের ছিদ্র দিয়ে। ওপাশে ফোন ধরেন স্বয়ং ড. হুমায়ূন আহমেদ। ঠিক হয় কাল বিকাল তিনটায় আমি তাঁর বাসায় যাব। আমার সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফারও থাকবে।

কাল বিকেল তিনটা, এখন থেকে প্রায় ২২ ঘণ্টা বাকি। আমার চোখে মুগ্ধ হওয়ার স্বপ্ন। বাবুকে সব ঘটনা খুলে বলি। বাবু উৎসাহী হয়ে পড়ে। সে প্ল্যান করেছে, তার ক্যামেরার সাথে রুমের বড় টেপ-রেকর্ডারটাও নিয়ে যাবে। সারা রাত জেগে নোটবুকে কতগুলো প্রশ্ন লিখে রাখি। হাতের কাছে ছিল একটা উপন্যাস, ‘তোমাকে’, সেটাও পড়ে ফেলি। আমি এই প্রথম পর পর দুইদিন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করে করে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তারিখটা ছিল ২১ ও ২২ জানুয়ারি ১৯৮৬।

ডাঃ ফজলে রাব্বি হলের ৮ নং রুমে আরেকজনের সাথে পরিচয় হয়। নাম তৌকীর। সেও নাকি বুয়েটে চান্স পেয়েছে। আর্কিটেকচারে। তবে তাকে গভীর রাত না হলে রুমে পাওয়া যায় না। বিকেলে টিউশনি করে। এক ছাত্রীকে বাড়ি গিয়ে ড্রয়িং শেখায়, আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দেবে মেয়েটি। আবার এক কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়। প্রতি ক্লাসে ১০০ টাকা পায়। তার ভালো ইনকাম। সে আবার ‘থিয়েটার’ দলেও নাকি চান্স পেয়েছে। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা যায়।

এরমধ্যে একদিন এই হোস্টেলের ঠিকানায় রি-ডাইরেক্ট করা রেজিস্টার্ড উইথ এডি একটা খাম আসে আমার কাছে। খামের ওপরে লেখা—রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহৃত। খুলে দেখি সিলেট বেতারের একটা চুক্তিপত্র আর ৪৮০ টাকার মানি রিসিট। সেখানে লেখা—‘যে যাহা করো রে বান্দা আপনার লাগিয়া  নামক সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার নাটকটি আগামী ১৭ জানুয়ারি সিলেট বেতার থেকে প্রচার হবে।’

আমি মহা উত্তেজিত হয়ে খবরটি তৌকীরকে জানাই। সে তখন থিয়েটারে নতুন ডাক পেয়েছে। প্রতিদিন ওয়ার্কশপে যায়, ফেরে গভীর রাতে। আমার ইচ্ছা করে তার সাথে নাটকের রিহার্সালের গল্প শুনতে। কিন্তু তাকে ফ্রি পাওয়া যায় না।

আর আমি ছোট্ট একটা অটোফোকাস ইয়াশিকা এমএফটু ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি। ছবি তুলি। দুয়েকটা পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপিয়ে পরের সপ্তাহ থেকে সেই পত্রিকা অফিসে বিল সংগ্রহের জন্য ঘুরে ঘুরে সময় কাটাই আর নতুন টিউশনি খুঁজি। এই নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে সপ্তাহ দুই পরে তিতুমীর হলের সিটে আমার জায়গা হয়। আমি বুয়েট জীবন শুরু করি। ১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় আমাদের ক্লাস। তার কিছুদিন পর বুয়েটের তিতুমীর হলের ১০৬ নং রুমে আমার ঠাঁই হয়। শুরু হয় আসল বুয়েটকাল।

কিস্তি ৩. বুয়েটপরশ

   

মহাশূন্যে যাবে জাপানের তৈরি কাঠের স্যাটেলাইট



বিজ্ঞান ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের জন্য কাঠের স্যাটেলাইট তৈরি করেছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। এটি স্পেসএক্স থেকে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

বুধবার (২৯ মে) ইয়েমেনের বার্তাসংস্থা সাবা এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

খবরে জানানো হয়, জাপানের কিয়েটো বিশ্ববিদ্যালয় ও সুমিটোমো ফরেস্ট্রি ফাউন্ডেশন বিশেষজ্ঞেরা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরের চেষ্টায় এই স্যাটেলাটটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

বুধবার কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিজ্ঞানীরা ৪ বছরের কঠোর পরিশ্রম করে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছেন। এই স্যাটেলাইটের নামকরণ করা হয়েছে, ‘লিগনোস্যাট’ (LignoSat)। এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম কাঠের তৈরি স্যাটেলাইট। পরিবেশের কথা চিন্তা করে এই স্যাটেলাইটটি তৈরি করা হয়েছে। এটি যখন তার অভিযান শেষ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে, তখন এটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটির আকৃতি ১০ সেন্টিমিটার। এটির পুরুত্ব ৪ থেকে ৫.৫ মিলিমিটার। তবে এটির ভেতরের স্তর হবে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি এবং এর ভেতরে একটি সোলার প্যানেল থাকবে। সবমিলিয়ে এটার ওজন হবে মাত্র এক কেজি। এই স্যাটেলাইট সম্পূর্ণ সনাতনী জাপানি পদ্ধতিতে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের ‘অ্যাডহেসিভ’ (আঠা) ব্যবহার করা হয়নি।

জাপানি বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স থেকে এ বছরই উৎক্ষেপণ করা হবে। তারা আরো জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে এটি পৃথিবীর বাইরে পরীক্ষামূলকভাবে উড়াল সম্প্ন্ন করেছে। স্যাটেলাইটটি কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তা অবশ্য জানানো হয়নি।

;

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;