চে, বিপ্লব ও বাজার



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাজারের রীতি হলো সবকিছুকে পণ্যায়ন করা। মানুষ তাই এখন যতটা সামাজিক তারচে বেশি বাজারিক হয়ে উঠছেন। এটি আমার বা আমাদের অনেকেরই অসহায়ত্ব। যেমন চে গুয়েভারার বিপ্লবী জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে আমেরিকা কম ব্যবসা করেনি। এত ব্যবসা করেছে যে মৌলবাদী সেই ছেলেটিও আমাকে চে-কে না জেনে বলেছিল, চে কোনো মডেল বা সিঙ্গার। চে-র কন্যা সিলিয়া কয়েকবছর আগে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। কেন জানেন? তার বাবাকে নিয়ে তৈরি করা পণ্যের বাজারে বিক্রির রয়ালিটি তাকে দেওয়ার জন্যে। বিপ্লবী চে-র কন্যা সিলিয়া হয়ে উঠেছেন চে-র বিপরীত আদর্শের। শুধু টাকা চান টাকা। তার কাছে তার বাবার বিপ্লবী জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান টাকা। হেরাল্ড ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চে-কন্যা সিলিয়া বলেন, “আমি জানি ওমন বিপ্লব আর হবে না। ভোগবাদী সমাজে আমি ভালোই থাকতে চাই।” তার একথা শুনে ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমেস্কি বলেন, “চে-কে আমেরিকা আর ভয় না পাওয়ার কারণ তাকে বাজারের সব ক্রেতারা কিনে ফেলেছে। এমনকি তার কন্যাও। আরেকটি কারণ চে, মার্কস, লেনিন, মাও সেতুংয়ের মতো কোনো বিপ্লবের বই লিখে যাননি।” (শিকাগো এড্রেস, নোটেবল মার্কেট, ২০১৪)

অথচ চে ছিলেন বিপ্লবী। চে-র জন্ম আর্জেন্টিনার রোসারিওতে ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন। একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, ডাক্তার, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবায় বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি কঙ্গোসহ বিভিন্ন দেশে গেরিলা লড়াই করেছেন। কিন্তু মারা যাননি। মারা যান বলিভিয়ার জঙ্গলে। ঝুলিতে তখন তাঁর এক নোটখাতাভর্তি প্রিয় কবিদের কবিতা।

বলিভিয়ার জঙ্গলে থাকতে চে ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “আমি ভাবতে শুরু করি, মরে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ সেটাই, যখন মনে হবে সব শেষ হয়ে গেছে। জ্যাক লন্ডনের একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ছে। তাতে গল্পের মূল চরিত্র একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে গরিমার সঙ্গে নিজের জীবনের সমাপ্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জ্বলে নেভে ফ্যাসিস্ট ও বিপ্লবীর চরিত্র

চিলির কবি পাবলো নেরুদা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ মেমোয়ার্স বইয়ে চে গুয়েভারার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনা লিখেছেন। ফরাসি লেখক রেজেস দেব্রের মাধ্যমে পাবলো নেরুদা জেনেছিলেন, বলিভিয়ার পাহাড়ে একেবারে শেষ পর্যন্ত তাঁর ডুফেল ব্যাগে (দড়ি দিয়ে বন্ধ করা যায় এমন ব্যাগ) শুধু দুটি বই রাখতেন চে; একটি অংকের, অন্যটি তাঁর (নেরুদার) কবিতার বই কামেত্মা জেনারেল। রেজেস দেব্রে, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত জনপ্রিয় বই রেভ্যুলেশন ইন রেভ্যুলেশনের লেখক কিউবা বিপ্লবের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি বলিভিয়ায় চে-র সঙ্গে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং একসময় গেরিলাযুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য কাজ নিয়ে চলে আসার সময় ধরা পড়ে যান। বিচারে তাঁর ৩০ বছর জেল হয়েছিল। পরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গল ও প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে দেব্রে মুক্তি পান।

চে-র সঙ্গে পাবলো নেরুদার প্রথম এবং একমাত্র সাক্ষাৎকারটি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। দেখা হয়েছিল হাভানায়। চে সাক্ষাতের সময় দিয়েছিলেন মধ্যরাতে। তাঁর অর্থ-দপ্তরে নেরুদা গিয়ে পৌঁছেছিলেন রাত একটায়। নেরুদার আত্মজীবনী মেমোয়ার্সের বর্ণনা এমন, “সে রাতে চে-র পরনে ছিল বুট আর সামরিক পোশাক, কোমরে পিস্তল। অফিসের ব্যাংকিং আবহে তাঁর পোশাকটাকে লাগছিল পুরোদস্তুর বেমানান। শ্যামলা, ধীরভাষী চে-র কথায় আর্জেন্টাইন টান স্পষ্ট। তিনি হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে আপনি পামপায় (আর্জেন্টিনার তৃণভূমি) ধীরে-সুস্থে একটার পর একটা ‘মাতে’ (একধরনের পানীয়) খেতে-খেতে কথা বলতে পারেন। তাঁর বাক্য ছোট-ছোট আর হাসি দিয়ে শেষ হয়, যেন আলোচনাটাকে অমীমাংসিত রাখতে চান। ওই রাতে চে আমাকে এমন একটা কথা বলেন, শুনে চমকে উঠেছিলাম। তবে এ কথাটার মধ্যেই হয়তো নিহিত ছিল তাঁর নিয়তি। আমার চোখ থেকে অফিসের অন্ধকার জানালায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁর দৃষ্টি। কিউবায় সম্ভাব্য দক্ষিণ আমেরিকান আগ্রাসন নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। হাভানার রাসত্মায় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানে আমি বালুর বস্তা ছড়ানো-ছিটানো দেখেছি। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘যুদ্ধ… যুদ্ধ… আমরা সবসময় যুদ্ধবিরোধী, কিন্তু একবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পরে যুদ্ধ ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। তারপর সর্বদা খালি যুদ্ধের কাছেই ফিরে যেতে চাই আমরা।’ আমার বই কামেত্মা জেনারেল সম্পর্কে তিনি যা বললেন, শুনে আমি কৃতার্থ। সিয়েরা মায়েস্ত্রায় রাতে গেরিলাদের এটা পড়ে শোনাতেন তিনি। এত বছর পর এখনো ভাবলে আমার শরীর কেঁপে ওঠে, যখন মনে পড়ে, মৃত্যুতেও তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিল আমার কবিতা। তাঁর কথা শুনতে-শুনতে চমকে উঠেছিলাম।”

১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর। লা হিগুয়েরা গ্রামের ছোট্ট একটা স্কুলঘরে বন্দী বিপ্লবী চে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর সামনে এক তরুণ সেনা কর্মকর্তা। চে তখন বিষণ্ন মনে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওই তরুণ সৈনিক বললেন, “নিজের অমরত্বের কথা ভাবছেন?” জবাবে চে বললেন, “না, আমি বিপ্লবের অমরত্বের কথা ভাবছি।” কিছুক্ষণ পর মারিও টেরেন্টের আট-দশটা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল চে গুয়েভারার শরীর। সেই কবি ও বিপ্লবী চে-র কিছু চিঠি আবিষ্কৃত হয়। তিনটি চিঠি দেওয়া হলো:

সন্তানদের প্রতি চে
প্রিয় হিলদিতা, আলিদিতা, ক্যামিলো, সিলিয়া ও আর্নেস্তো
কোনো একদিন তোমরা যখন এই চিঠি পড়বে, সেদিন হয়তো আমি তোমাদের মাঝে থাকব না। তোমরা হয়তো আমাকে স্মরণই করবে না। সবচেয়ে ছোটটি তো আমাকে তার মনেই আনতে পারবে না।

তোমাদের বাবা ছিল এমন একজন মানুষ, যেটা সে ভালো বলে ভেবেছে, সেই কাজটাই করেছে। এবং সে ছিল তার আত্মপ্রত্যয়ের প্রতি শতভাগ বিশ্বাসী, সংকল্পের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

তোমরা বেড়ে ওঠো বিপ্লবী হয়ে। প্রচুর পড়াশোনা করো, যাতে তোমরা এমন কৌশল আয়ত্ত করতে পারবে, যেটা তোমাদের জন্য এনে দেবে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব। মনে রেখো, সব ক্ষেত্রেই বিপ্লব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একক ও বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের কারোরই কোনো মূল্য নেই।

তোমরা সংবেদনশীল হও নিজেদের ভেতরের বিষয়গুলোতে এবং দুনিয়ার যে কারো ওপর যে কোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে পবিত্র গুণ এটি।

ওরে আমার প্রাণের সন্তানেরা, আশা করি তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।

বিশাল বড় চুমু রইল তোমাদের জন্য। তোমাদের বাহুডোরে বেঁধেছে যে।
- ইতি তোমাদের বাবা

চে তোমার কন্যা সিলিয়ার জন্য আমাদের খারাপ লাগে। তোমার জন্য তো লাগেই। কিন্তু সিলিয়া এখন আমেরিকান সিটিজেন। জানো না তুমি, সে এখন রিপাবলিকান দলের সমর্থক। সরি, চে। বিপ্লবের রাস্তা বারবার এঁকেবেকে যায়।

মা-বাবার প্রতি চে
প্রিয় মা-বাবা,
আরো একবার পায়ের নিচে অনুভব করছি রোসিয়ান্তের পথ। প্রায় ১০ বছর আগে তোমাদের কাছে আরেকটি বিদায়ের চিঠি লিখেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, আমি তখন আফসোস করতাম একজন ভালো সৈনিক বা একজন ভালো ডাক্তার হতে না পেরে। দ্বিতীয়টি আমাকে আর টানে না; আর আমি আসলে সৈনিক হিসেবেও মন্দ নই। সেদিনের আমি আজও কোনো বিষয়েই বদলে যাইনি। শুধু আগের চেয়ে আরো বেশি সচেতন হয়েছি।

আমার ভেতরে মার্কসবাদ শেকড় গেড়েছে, হয়েছে আরো শুদ্ধ। আমার এই বিশ্বাস অটল রয়েছে যে, যারা নিজেদের মুক্ত করতে চায় তাদের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামই একমাত্র পথ। আর আমি আমার বিশ্বাসে সর্বদা স্থির। অনেকেই আমাকে দুঃসাহসিক অভিযাত্রী বলে ডাকতে পারে। এবং আসলেই আমি তাই। তবে একটু আলাদা ধাঁচের মানুষ আমি, যে তার বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে শরীরের চামড়া আগুনে পোড়াতে পারে।

সম্ভবত এটাই আমার শেষ চিঠি। আমি তা চাই না। কিন্তু সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এটাই যৌক্তিক। তাই যদি হয়, তবে আমি তোমাদের জন্য বিদায় আলিঙ্গন পাঠাই। আমি তোমাদের অনেক ভালোবেসেছি। আমি শুধু জানি না কিভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। কাজের বেলায় আমি চরম কঠিন। এজন্য মনে হয়, কখনো কখনো আমাকে তোমরা বুঝতেই পারোনি। যা হোক, আজ আমাকে বিশ্বাস করো।

শিল্পীর আনন্দ নিয়ে আমার ইচ্ছাশক্তিকে আমি শাণিত করেছি, তা-ই আমার কম্পিত পা আর ফুসফুস সত্ত্বেও সেই শক্তিতে আমি অবিচল। আমি সেটাই করব। আমি এটা করতে চাই। কখনো কখনো এই বিংশ শতাব্দীর সৈনিকটির কথা ভেবো।

সিলিয়া, রোবার্টো, জন মার্টিন ও পাতোতিন, বিটরিজ—সবার জন্য চুমু রইল। তোমাদের বাহুডোরে বেঁধে রাখতে চায় জেদি ও হারিয়ে যাওয়া ছেলে।
- আর্নেস্তো, ১৯৬৫

এই চিঠিটি ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে লেখা চে গুয়েভারার শেষ চিঠি। এটা ফিদেল ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে পান এবং ৩ অক্টোবর একটি ভাষণে তিনি কিউবার জনগণের কাছে এটি পড়ে শোনান। চিঠিটি হুবহু তোলে ধরা হলো:

এই মুহূর্তে আমার অনেক কথা মনে পড়ছে যখন মারফা এন্টোনিয়াসের বাসায় তোমার সাথে আমার দেখা হলো, যখন তুমি আমাকে তোমার সাথে যোগ দিতে বললে এবং প্রস্তুতিপর্বের সাথে সম্পৃক্ত সব দুঃশ্চিন্তাগুলো।

তারা একদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিল মৃত্যু হলে কাকে জানানো হবে, এবং তার সত্যিকারের সম্ভাবনা আমাদের সবাইকে আচ্ছন্ন করেছিল। পরে আমরা জেনেছিলাম যে এটা সত্যি ছিল, যে একটি বিপ্লবে একজন অর্জন করে বিজয় অথবা মৃত্যু, যদি সেটা সত্যিকারের বিপ্লব হয়। বিজয়ের পথজুড়ে অনেক সহযোদ্ধাকে আমাদের হারাতে হয়েছে।

আজ সবকিছু আর ততটা নাটকীয় নয়, কারণ আমরা এখন আরো পরিণত হয়েছি। কিন্তু সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। আমি মনে করি আমি কিউবান বিপ্লবের সাথে যে বন্ধনে জড়িয়েছিলাম, আমি আমার সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করেছি, এবং আমি তোমাকে বিদায় জানাচ্ছি, সহ-যোদ্ধাদের এবং তোমার সব লোকেদের, যারা ইতোমধ্যেই আমার আপনজন হয়ে উঠেছে।

আমি আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টির জাতীয় নেতৃত্বস্থানীয় পদ থেকে, মন্ত্রীর পদ থেকে, আমার মেজর পদমর্যাদা থেকে পদত্যাগ করছি এবং আমার কিউবান নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করছি। আমার কোনোকিছুই আর আইসঙ্গতভাবে কিউবার সাথে সম্পৃক্ত নয়। যে বন্ধন রইল তা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের, যেটা পদত্যাগ করার মতো সহজে ভেঙে ফেলা যায় না।

আমার অতীত জীবন স্মরণ করে, আমি বিশ্বাস করি যে, আমি আমাদের বৈপ্লবিক বিজয়কে সুদৃঢ় করতে পর্যাপ্ত সন্মান এবং ত্যাগের সাথে কাজ করেছি। সিয়েরা মায়েস্ট্রার প্রথম মুহূর্তগুলোতে তোমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আমি যেমন ভুল করিনি, তেমনভাবে একজন নেতা এবং বিপ্লবী হিসেবে তোমার যোগ্যতা বুঝতেও আমার দেরি হয়নি। আমি চমৎকার সময় কাটিয়েছি, ক্যারিবিয়ান সংকটের সেই উজ্জল তথাপি দুঃখের দিনগুলোতে তোমার পাশে থেকেও আমি আমাদের জনতার অংশ হওয়ার গর্ব অনুভব করেছি। সেইসব দিনগুলোতে তুমি একজন অত্যন্ত দক্ষ লোকের থেকেও বেশি মেধাবী ছিলে। তোমাকে নিঃসঙ্কোচে অনুসরণ করে, তোমার চিন্তা, বিপদ দেখে জানানোর ক্ষমতা এবং তোমার নীতির সাথে নিজেকে একাত্ম করতে পেরে আমি গর্বিত। পৃথিবীর অন্য জাতিরা আমার বিনয়ী প্রচেষ্টা আহবান করছে। আমি সেটা করতে পারি যেটা কিউবার প্রধান নেতা হিসেবে অর্পিত দ্বায়িত্বের কারণে তুমি করতে সমর্থ হবে না, এবং আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সেই সময় উপস্থিত।

আমি এটা সবাইকে জানাতে চাই যে, আমাকে আনন্দ এবং দুঃখের একটি মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এটা করতে হচ্ছে। আমি একজন নির্মাতা হিসেবে আমার বিশুদ্ধতম আশা রেখে যাচ্ছি, এবং সেই কাছের মানুষদের যাদের আমি ভালোবাসি। এবং আমি এমন একটি জনগণের কাছ থেকে চলে যাচ্ছি যারা আমাকে তাদের ছেলের মতো বরণ করে নিয়েছিল। এটা আমাকে গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত করে। যে বিশ্বাস তুমি আমাকে শিখিয়েছো, আমার জনতার যে বিপ্লবী আদর্শ তা আমি নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছি, সাথে নিয়ে যাচ্ছি সকল কাজের পবিত্রতম সেই কাজ করার অনুভূতি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেটা যেখানেই হোক না কেন। এটা আমার গভীরতম ক্ষতও সান্ত্বনা দিয়ে সারিয়ে তুলছে।

আমি আগেও একবার বলেছি কিউবা আমার যে কোনো ধরনের দ্বায়িত্ব থেকে মুক্ত, সেটা ছাড়া যেটা উদাহরণ থেকে উদ্ভূত হয়। যদি অন্য কোনো দেশে আমার জীবনের শেষ সময় কাটাতে হয়, আমার শেষ চিন্তা হবে এই জনগণের বিষয়ে, বিশেষভাবে তোমার জন্য। তোমার শিক্ষা এবং উদাহরণের জন্য আমি কৃতজ্ঞ, এবং আমি আমার শেষ পরিণতি পর্যন্ত আমার কাজে বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করব।

আমি সবসময়ই বিপ্লবের বৈদেশিক নীতির সাথে একমত ছিলাম, এবং আমি তাই থাকব। আমি যেখানেই যাই, আমি একজন কিউবান বিপ্লবীর দায়িত্ব অনুভব করব এবং সেইমতো আচরণ করব। আমি এজন্য দুঃখিত নই যে, আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যাচ্ছি না। এটাতে বরং আমি খুশি। আমি তাদের জন্য কিছুই চাই না, কারণ আমি জানি সরকার থেকে তাদের খরচ এবং পড়াশোনার জন্য যথেষ্টই দেওয়া হবে।

তোমাকে এবং আমাদের জনগণকে আমি আরো অনেক কিছু বলতাম, কিন্তু আমি মনে করি সেটা অপ্রয়োজনীয়। আমি তাদের কিভাবে দেখতে চাই তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয় এবং তাই শুধু শুধু পৃষ্ঠায় আঁচড় কাটার কোনো মানেই হয় না।

বিজয়ের পথে আজীবন! হয় স্বদেশ নয় মৃত্যু! আমার সমস্ত বৈপ্লবিক ঐকান্তিকতা নিয়ে তোমাকে আলিঙ্গন।
- চে

   

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত



নাজমুল হাসান
কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। 'ভাঙার গান' শিরোনামেই কবিতাটি 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান; কবিতাটির শিরোনামের মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পটভূমি:

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ব্যাপকভাবে তরুণদেরকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। ওই সময় 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার হাল ধরেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী।

একদিন বাসন্তী দেবী 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দাশ পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ সময়ে নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদ কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। 'ভাঙার গান' শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন- "আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম।‌ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।”

পড়া শেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুকুমাররঞ্জন দাশের হাতে দেন, যা 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুরারোপ করে সে গানের স্বরলিপিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন বলে জানা যায়। ফলে এ গানের সুরকার নজরুল ইসলাম নিজেই। এই কবিতাটি লেখার দুই/তিন সপ্তাহ আগে ওই বাড়িতে থাকার সময়েই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনিসহ সেখানে বন্দি থাকা অন্যান্য স্বদেশী আন্দোলনের বন্দিরা একত্রে কোরাস আকারে কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সুরে সর্বপ্রথম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি জেলখানার ভিতরেই গেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ রাজরোষের কারণে কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু'র দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামে নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এ মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরেরদিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নজরুল ইসলামকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ এই এক বছর জেলে রাখা হয়। জেল-জীবনে কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে তিনি বহুবার এ গানটি গেয়েছেন। যদিও সে গানের কোনো রেকর্ড নাই। পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া এ গানটি সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া সুরই ছিল নজরুল ইসলামের নিজের করা সুর।

মূলভাব:


‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। গানটির মাধ্যমে কবি যে দ্রোহের প্রকাশ করেছেন তা হলো—প্রতিবাদ-ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জাগ্রত হবে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বাধীন জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলো ছড়াবে। গানটির মাধ্যমে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আমিয় বাণী।

কবিতাটির প্রকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. পত্রিকা: বাঙলার কথা, শিরোনাম: ভাঙার গান, ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮।
২. কাব্যগ্রন্থ: ভাঙার গান, প্রথম সংস্করণ- শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’। দ্বিতীয় সংস্করণ- ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম স্ট্রিট, কলিকাতা- ১২। খ্রিষ্টাব্দ ১৯৪৯ । কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’ (গান) ১। পৃষ্ঠা: ১-২।
৩. নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬। ভাঙার গান। গান-১। পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০।

গানটির রেকর্ড সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. Columbia Records- কলাম্বিয়া রেকর্ডস, প্রখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি কলাম্বিয়া’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রেকর্ড। জুন ১৯৪৯, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬, জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
২. এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার’স ভয়েস- His Master's Voice, জানুয়ারি ১৯৫০, পৌষ-মাঘ ১৩৫৬, এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
৩. ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা ভোট দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি ১৬তম।

গানটির চলচ্চিত্রে রূপদান সংক্রান্ত ইতিহাস:

১. চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কাহিনীকার- চারুদত্ত। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক- নির্মল চৌধুরী। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্টুডিওর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর, রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬। গানটির চলচ্চিত্রের স্বরলিপিকার ও স্বরলিপিতে করেছিলেন- রশিদুন্‌ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, পঞ্চম গান। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
পর্যায়: বিষয়াঙ্গ- স্বদেশ, সুরাঙ্গ- সামরিক মার্চ, তাল- দ্রুত দাদরা, গ্রহস্বর: সা।
লিঙ্ক: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন https://www.youtube.com/watch?v=F1StxYnf-yU

২. চলচ্চিত্র: জীবন থেকে নেয়া। জহির রায়হান নির্মিত শেষ কাহিনী চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী: খান আতাউর রহমান। শিল্পী: অজিত রায়, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও অন্যান্য। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লিঙ্ক: জীবন থেকে নেয়া https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ উভয় চলচ্চিত্রেই শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং অজিত রায় ও খন্দকার ফারুক আহমেদ গানটিকে কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন। দুটি চলচ্চিত্রের গানের সুরের মধ্যে সামান্য একটু ভিন্নতা থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই গানটির বিপ্লবী মূলভাব ফুটে উঠেছে। চেতনার সাথে মিল রেখে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটিকে বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। মূল গানটি জেলখানায় বসে কয়েদিরা কোরাস কণ্ঠে গেয়েছিলেন বলে দুটি চলচ্চিত্রেই গানটিকে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা কোরাস কণ্ঠে গাওয়ানো হয়েছে।

কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।


ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

এখানে ‘কারা’ মানে কারাগার, তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতের যে কারাগারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত তরুণ বিপ্লবী বীরদের গ্রেপ্তার করে আটক করে রাখছিল। সেই কারাগারের শক্ত লোহার দরজা তথা লৌহকপাট ভেঙে ফেলে তাকে লোপাট অর্থাৎ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘পূজার বেদী’ হলো যেখানে পূজা করা হয়, সে শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান। পূজার বেদীতে মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা পরম ভক্তির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কবি এখানে স্বদেশকে পূজার বেদীর সাথে তুলনা করেছেন। যে পূজার বেদীতে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য থাকার কথা সে বেদীতে আজ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অত্যাচারিত ভারতের বীর সন্তান, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবীদের রক্ত জমাট বেঁধে আছে, সে বেদীতে আজ পরাধীনতার শিকল পরানো। এ বেদী আজ বেদী নেই, একে নির্মমতার পাষাণে পরিণত করা হয়েছে। এ শিকল ভেঙে, জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে পাষাণময় পূজার বেদীকে মুক্ত করে মায়াময় ও পবিত্র করতে হবে, অর্থাৎ পরাধীন দেশের শোষণ-নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত-স্বাধীন করে তাকে উপভোগ্য ও আত্মনির্ভর করতে হবে।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে যেভাবে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে সেভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদের সক্ষমতাকে কবি প্রলয়ের দেবতা মহাদেবের মহাশক্তির সাথে তুলনা করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকল ভাঙতে প্রলয় বিষাণ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদি’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে কারাগারে আটক রেখেছে সে কারাগার ভেদ করে ফুড়ে বেরিয়ে আসে, পরাধীনতার প্রাচীর বা দেওয়াল ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীন-মুক্ত হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘গাজন’ সনাতনধর্মীদের একটা সামাজিক উৎসবের নাম। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের মিলিত বাজনা বাজিয়ে গাজন উৎসব পালন করা হয়। মিলিত বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজায় গাজন উৎসবের বাজনা খুব প্রকট হয়। কবি এখানে গাজনের বাজনার মতো প্রবল শব্দে বাজনা বাজিয়ে লড়াইয়ে নেমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার তীব্র আহ্বান জানিয়েছেন।

কবি এখানে ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরূপ প্রকাশ করার নিমিত্তে পরাধীন ভারতবাসীকে প্রশ্ন করেছেন—কে মালিক, কে রাজা, কে সাজা দেয়, কে মুক্ত, কে স্বাধীন, কে সত্য? অর্থাৎ ওরা বিদেশি, ভিনদেশি, ওরা আমাদেরকে শাসন করার অধিকার রাখে না। এ দেশ আমাদের, এ দেশের মালিক আমরা, এ দেশের রাজা আমরা, এখানে আমরা মুক্ত-স্বাধীন, এখানে আমাদেরকে কেউ সাজা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এখানে আমরাই সত্য, ওই ব্রিটিশরাই এখানে মিথ্যা। ওরা মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে না।

হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ভগবান মানে সর্বশক্তিমান, সর্বমুক্তমান, সর্বমালিক মহাশক্তি। কবি এখানে ভগবান বলতে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীরদের বুঝিয়েছেন। তারাই এ দেশের মালিক। ভগবানকে যেমন বন্দি রাখা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বন্দি করা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বেঁধে রাখা তথা ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, ভগবানকে যেমন ধ্বংস করা অসম্ভব—তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীর, যারা এ দেশের মালিক তাদেরকেও বেঁধে রেখে তথা বন্দি রেখে ফাঁসির দড়ি পরানো অসম্ভব। সুতরাং এই বীরদেরকে জেলে আটকে রেখে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেওয়ার যে পায়তারা ব্রিটিশরা করছে তা দেখে কবির হা হা হা কোরে অট্টহাসি পাচ্ছে। কারণ, স্বাধিকারের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ-সংগ্রাম চলছে তাতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভগবান অর্থাৎ এ দেশের বিপ্লবী-বীরদেরকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব।

ব্রিটিশ শাসকেরা বিপ্লবী-বীর ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দেরকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়ার কথা প্রচার করে মানুষকে বিপ্লব-বিরোধী করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। তাদের এ চক্রান্তে যাতে মানুষ ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যায় সে জন্য কবি প্রচণ্ড আস্থার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন—বিপ্লবী-বীরদের ফাঁসি দেওয়া যায়, এমন হীন অর্থাৎ নীচ ও জঘন্য তথ্য কে শেখাচ্ছে? কে ছড়াচ্ছে এমন অসম্ভব কথা? অর্থাৎ কবি মানুষকে অভয় দিচ্ছেন যেন ব্রিটিশ শাসকদের এমন চক্রান্তে ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে না যায়। কারণ, এই বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির দেবতা দুটোই শিব বা মহাদেব। অর্থাৎ মহাদেব ইচ্ছে করলে যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছে করলে আবার প্রলয় বা ধ্বংসও করতে পারেন; এটা নিতান্তই তাঁর খেয়াল। এজন্য শিবকে বলা হয় ‘পাগলা ভোলা’। কবি এখানে জেলখানায় বন্দি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদেরকে ‘পাগলা ভোলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবির মতে ব্রিটিশ সরকার এই পরাধীন ভারতের পুরোটাকেই কারাগার বানিয়ে রেখেছে। ফলে এই কারাগারে বন্দি প্রতিটি মানুষই আসলে ‘পাগলা ভোলা’। পরাধীনতার কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী মানুষকে কবি আহ্বান করছেন তাঁরা যেন মহাশক্তিধর ‘পাগলা ভোলা’ তথা মহাদেবের ধ্বংস বা প্রলয় ক্ষমতার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো ভারতবর্ষকে দোলা দিয়ে কাঁপিয়ে তাঁদের ক্ষমতার জানান দেয়। তাঁরা যেন এই কারাগার বা গারদের লোহার শিক জোরসে ধরে হেচ্‌কা টান দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে আসে।

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘হায়দার’ অর্থ শক্তিশালী, তরবারি বা সত্যের তলোয়ার। আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর আপন চাচাত ভাই ও জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর প্রচণ্ড শক্তি ও শৌর্য-বীর্য থাকার কারণে তাকে ‘হায়দার’ বলা হয়। ‘হাঁক’ শব্দের অর্থ হুংকার। কবি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে হজরত আলীর সেই হায়দারী হাঁকের মতো প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে পদানত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

‘দুন্দুভি ঢাক’ হলো একপ্রকার বৃহৎ ঢাক বা দামামা জাতীয় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, রণবাদ্যবিশেষ। বন্দি-জীবন আসলে মৃতপ্রায়-জীবন; কবি বন্দিদশাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন এবং সেই মৃত্যুদশা থেকে জীবনকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশে সজীব হয়ে গৌরবের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সে সাহস সঞ্চার করেছেন।


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বাংলা বৈশাখ মাস এবং এর কাছাকাছি মাসগুলোতে যে প্রচণ্ড ঝড় হয় তাকে ‘কালবোশাখী’ বলে। পরাধীন ভারতবাসীর মনের ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ ক্রমাগত তোলপাড় করে চলেছিল তাকে কবি কালবোশাখীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি মুক্তিকামী দ্রোহী ভারতবাসীকে কালবোশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয় শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, এখন বৃথা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। এভাবে কাল বা সময় হরণ করা খুবই অনুচিত। সময় নষ্ট না করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম হলো পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব। ভীম অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বীরদের উপরে ব্রিটিশরাজ ভীমের শক্তি প্রয়োগ করে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ভীমের মতো শক্তিশালী কারাগারে বন্দি করে রাখছে। কবি ভারতবাসীকে আহ্বান করছেন যেন তারা তাদের সংগ্রামী শক্তি প্রয়োগ করে ওই ‘ভীম কারা’ বা শক্ত কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তা উপড়ে ফেলে মুক্তি-সংগ্রামীদের মুক্ত করে আনে।

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বল প্রয়োগ করে যারা ভারতবর্ষকে দখল করেছে তাদের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী নন, তিনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্দিরা কবে মুক্তি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কি না সে অপেক্ষায় তিনি বসে থাকতে রাজি নন। তিনি জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে একত্র করে এখনই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল বন্দিশালা বা কারাগার ভেঙে সকল বন্দিকে মুক্ত করতে চান। এই শক্তি প্রয়োগকেই কবি ‘লাথি’র সাথে তুলনা করেছেন এবং মুক্ত হওয়াকে ‘তালা ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন “লাথি মার ভাঙ্গরে তালা”।

‘আগুন-জ্বালা,ফেল উপাড়ি’ শব্দগুলি দিয়ে কবি স্বদেশীদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন যেন তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের সকল অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনকে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলেন, উচ্ছেদ করেন। এ দেশের মালিক হবে এ দেশেরই জনগণ, এ দেশকে শাসন করবে এ দেশেরই জনপ্রতিনিধি, ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ-নির্যাতনমুক্ত দেশ।

গানটি বিকৃতির ইতিহাস:

রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত, আরএসভিপি মুভিজ এবং রায় কাপুর ফিল্মস প্রযোজিত, ইশান খাট্টার, মৃণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলি ও সোনি রাজদান প্রমুখ অভিনীত ‘পিপ্পা’ ছবিটি ১০ নভেম্বর ২০২৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ছবিটিতে নজরুলের গান 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর রিমেক করা হয়েছে। অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের রিমেক সংস্করণে গানটি গেয়েছেন ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী।

এ আর রাহমান বাংলা গান নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন তিনি করেছিলেন। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটির সুরারোপও তিনি নিজের মতো করেছেন। তবে নজরুল সংগীত নিয়ে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার তাঁর রেমিক সংস্করণে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির মূল সুরের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট রাখেননি। বিপ্লবী-বিদ্রোহী চেতনার ভাব ও সুরের গানটিকে তিনি লোকগীতির রোমান্টিক ঢংয়ে পরিণত করে নষ্ট করে ফেলেছেন। এমন একটি রুদ্র চেতনার গানকে হত্যা করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন যা ক্ষমাহীন।

মূল গানটি কারাগারে মধ্যে গাওয়া হলেও ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করে গানটি গাইছেন। গানটি গাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট এবং এর বিপ্লবী চেতনা এমন উত্সবপূর্ণ দৃশ্যের সাথে যায় না।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানের যে পরিবেশ দেখানো হয়েছে ওই পরিবেশে এই বিপ্লবী গানটি খাটে না। সিনেমার দৃশ্যে নরম সুরে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে আনন্দরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেটি মানানসই ও যুতসই হয়নি, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অসংগতির দায় স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালককে বহন করতে হবে। ফলে এ বিকৃতির জন্য এ আর রহমানের সাথে তারাও দোষী।

ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী এরা প্রতিষ্ঠিত গায়ক এবং সম্ভবত সবাই বা অধিকাংশই বাঙালি। এই গানের সুর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে এরা সবাইও বিকৃত সুরে গানটি গাওয়ার জন্য অপরাধী।

২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা তা শোনায়নি। ছবির নির্মাতারা এ দায় এড়াতে পারে না।

উপসংহার:
সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না, সবাই কালজয়ী সৃষ্টি করতে পারে না। যারা কালজয়ী সৃষ্টি করেন তারা তাদের সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেরাও কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সেই কালজয়ী স্রষ্টা; তিনি নিজেও অমর, তাঁর সৃষ্টিও অমর। 'ভাঙার গান' শিরোনামে লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নজরুলের সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও এক অনন্য সৃষ্টি। এ সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এ আর রহমান রাখে না। অনেকে বলেন—সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সৃষ্টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করা এবং তাকে বিকৃতরূপে প্রকাশ করা এককথা নয়। মানুষ যদি পুরনো সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ সানন্দে গ্রহণ করে তবেই তাকে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়, একেই বলে সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ।

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুর পরিবর্তন বাঙালি গ্রহণ করেনি, এটাকে বিকৃতি হিসেবে নিয়েছে। ফলে এ পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজমুল হাসান: লেখক ও চিকিৎসক।

;

কবি সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রদূত জননী সাহসিকাখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। 

মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সমস্ত প্রগতিশীল আন্দেলনে ভূমিকা পালনকারী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের এই দিন (২০ নভেম্বর) সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকেল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদস্থ রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এই আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।

পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।

১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ কার্ফু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।

সুফিয়া কামালের লেখা কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি। ‘কেয়ার কাঁটা’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ ছাড়াও তিনি ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতি কথা, শিশুতোষ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। সোভিয়েতের দিনগুলি এবং একাত্তরের ডায়েরী তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ।

সুফিয়া কামাল দেশ-বিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক।

;

গৌরীপুরে হুমায়ুন ভক্তদের পাখির আবাস তৈরি 



উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,গৌরীপুর,ময়মনসিংহ
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিনে পাখির নিরাপদ আবাসের জন্য গাছে গাছে পাখির বাসা ঝুলিয়েছেন ভক্তরা।

সোমবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে ভক্তদের সংগঠন হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফৌজিয়া নাজনীন উপজেলা পরিষদ চত্বরে হাড়ি-কলস ঝুলিয়ে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। পরে বন, বন্য প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় পৌর শহরে প্রচারাভিযান চালান ভক্তরা। এর আগে সোমবার হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফৌজিয়া নাজনীন বলেন, ‘গাছপালা ও বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় এখন আগের মতো পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় না। পাখি আমাদের প্রাণবৈচিত্রের অংশ। পরিবেশে পাখি বেঁচে থাকা খুবই জরুরি। পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকাও জরুরি। বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়। এ জন্য সাধারণ জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।'

এ সময় হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পদক প্রভাষক স্বপন কুমার ঘোষের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন শ্যামগঞ্জ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হারুন আলী বারী, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য এইচএম খায়রুল বাসার, বোকাইনগর ইউপি চেয়ারম্যান আল মুক্তাদির শাহীন, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু কাউছার চৌধুরী রন্টি, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রহিম, মোঃ শেখ সাদী সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীযুশ রায় গণেশ, প্রচার সম্পাদক হারুন মিয়া প্রমুখ।

;

‘খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত ছিলেন আবুল হাসনাত’



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে বিশিষ্টজনরা

‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে বিশিষ্টজনরা

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত ছিলেন খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এবং সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে নিরলস একজন মানুষ। প্রয়াত আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংকলন 'বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য' এর প্রকাশনা উৎসব ও স্মরণ আলোচনায় যোগ দিয়ে বিশিষ্টজনরা তাকে নিয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

রোববার (১২ নভেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে অনুষ্ঠিত হয় এই মোড়ক উন্মোচন ও স্মরণ আলোচনা অনুষ্ঠান। গ্রন্থটি ছিলো আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী।

আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সঞ্চালক প্রজ্ঞা লাবণীর কণ্ঠে তার কবিতা ‘স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়’ আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এর পর গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন পর্বে অংশ নেন- প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী ও আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক।  

আবুল হাসনাতের অগ্রন্থিত এই সংকলনে রয়েছে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ-সমালোচনা। এই বইয়ের প্রবন্ধ অংশে- বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীরকে নিয়ে যে প্রবন্ধাবলি রয়েছে, তাতে মূর্ত হয়েছে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে তার ভাবনার স্বরূপ। আর পাবলো নেরুদা ও ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ দুটিতে ফুটে উঠেছে তার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বইটি পাঠককে আবুল হাসনাতকে বুঝতেও সাহায্য করবে।

গ্রন্থটির ওপর আলোচনা ও লেখকের স্মরণে বক্তারা তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা এবং স্মৃতিচারণা করেন। আলোচনায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আবুল হাসনাত ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। তিনি মানুষের ভেতরে সততা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বপ্ন দেখতেন। জাতির সাহিত্য–সংস্কৃতির বিকাশে যারা নীরবে কাজ করে গেছেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম।

সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাতের ভূমিকা উল্লেখ করে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, কার ভেতরে কোন ধরনের মেধা ও সৃজনশীলতা আছে, তা তিনি চট করেই বুঝতে পারতেন। তাদের দিয়ে সেই ধরনের কাজ করিয়েছেন। তিনি বহু লেখককে প্রতিষ্ঠিত হতেও সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে নিজেও ছিলেন উঁচু মানের কবি, প্রাবন্ধিক ও শিল্প সমালোচক। তার বিভিন্ন রচনায় নান্দনিক ভাবনা, পরিশীলিত মেজাজ, পরিমিতিবোধ ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।'

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, 'আবুল হাসনাতের সঙ্গে পুরান ঢাকার নবাবপুর স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। এছাড়া ক্রিকেট খেলা, কবিতা লেখা, সাহিত্যচর্চা, ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছি। আবুল হাসনাত নেই, এটা বিশ্বাস করতে মন চায় না। পরবর্তী জীবনে আবুল হাসনাত দেশের সব লেখক, শিল্পীর ঘনিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তার নিজের লেখালেখিও অনেক। ২১টি মৌলিক গ্রন্থ, এককভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২১টি আর যৌথভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২২টি। তার লেখায় শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, ভাবনা উপস্থাপনা উচ্চ মানের। মৃত্যুর পর নির্মোহ মানুষটিকে আমরা যেনো আরও গভীরভাবে জানতে পারছি।  

লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে তিনি লেখক নন, বরং লেখার গুণমানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম থেকে তিনি ডাকে সংবাদের সাহিত্য পাতার জন্য লেখা পাঠাতেন। লেখাগুলো সাময়িকীতে গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হতো। কিন্তু তখন আবুল হাসনাতের সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয়ই ছিল না। আবুল হাসনাত স্বল্পভাষী, নেপথ্যচারী লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল খোলামেলা। গুণীর কদর করতে কার্পণ্য করেননি।'

আবুল হাসনাতের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, 'এটি আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে তিনি সারা জীবন নিরলস কাজ করেছেন। খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত প্রচারবিমুখ। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই মানুষটি মৃত্যুর আগেও কালি ও কলমের বিদ্যাসাগর সংখ্যা নিয়ে কাজ করে গেছেন। বারবার সেটি সম্পন্ন করার কথাই বলেছেন। নতুন প্রজন্মের প্রতি তার ছিলো গভীর আস্থা। তিনি মনে করতেন দেশের নতুন প্রজন্মই সব সংকটে জাতিকে উত্তরণের সঠিক পথ দেখাবে।

সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এতে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ সমালোচনা রয়েছে ৬টি। প্রতিটি লেখা সুলিখিত, প্রাণবন্ত। গভীর পাণ্ডিত্য আর বিষয়গুলোতে লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ রয়েছে। লেখা দুর্বোধ্য নয়। সব শ্রেণির পাঠকই লেখাগুলো পড়ে যেমন অনেক বিষয়ে জানতে পারবেন, তেমনি আনন্দও পাবেন। স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তিনি নিজেও ছিলেন নবাবপুর স্কুলের ছাত্র। তবে আবুল হাসনাতের চেয়ে পাঁচ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন।প্রচারবিমুখ আবুল হাসনাতের লেখা ভালোভাবে সংরক্ষণ এবং সেগুলো পরের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তার প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে- এমনটাই জানান তিনি।

আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, আবুল হাসনাতের স্মৃতিরক্ষা ও তার কাজ সংরক্ষণের জন্য আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। গত ১ নভেম্বর ছিল আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সে উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জানান, পর্যায়ক্রমে তার সব রচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ নিয়ে রচনাসমগ্র প্রকাশের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।

আবুল হাসনাত কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামে। কবিতা, উপন্যাস, চিত্র-সমালোচনাসহ সাহিত্যের নানা বিভাগে তিনি পদচ্ছাপ রেখেছেন। দেড় দশকের বেশি সময় সাহিত্য ও শিল্প–সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম এর সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। এর আগে তিনি দুই যুগের বেশি সময় দৈনিক সংবাদ–এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’ সম্পাদনা করেন। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর সাহিত্যিক ও শিল্প সমালোচক আবুল হাসনাত রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে মারা যান। একজন বিচক্ষণ ও সংবেদনশীল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন আবুল হাসনাত। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘদিন তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক ও সদস্য ছিলেন। ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন সাংবাদিক আবুল হাসনাত।

;