কাগজে কলমে
এই যে লিখছি সাদা ক্যানভাসের মতো শরীরে। এতে লিখে যে অতি ক্ষুদ্রমাত্রায় খাতার অনুভব পাওয়ার চেষ্টা করছি তার কারণ কাগজ। হয়তো এমন একদিন আসবে যখন কাগজে লেখা খুব কম হয়তো হবেও না, আবার উলটো হতে পারে, হয়তো এমন যান্ত্রিক লেখা সরে গিয়ে সেই আগের মতো পাতায়, কাঠে, পুঁথিতে লিখতে হবে। কারণ যদি আমরা ভেবে থাকি বিজ্ঞান কেবল এগিয়ে নিয়ে যাবে আর সে পথে কোনো বাঁধা আসবে না তাহলে সেটা মস্ত বড় ভুল কারণ সে যে ধাত্রের মধ্যে বসে আছে সে হলো প্রকৃতি—এই প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুদূর অবধি সূত্র ধরেই যাওয়া যায় কিন্তু পূর্ণমাত্রায় নয়। এই করোনাকালে তা আমরা বেশ বুঝেছি।
যাই হোক আসল কথা হলো এই কাগজ থাকবে অথবা থাকবে না সেই ভাবনা থেকে একে একটু স্মরণ করি, সাদা কাগজের গায়ে কালো অক্ষরের সে চলাফেরা যেন নকশা, যেন এক স্বপ্নের ভার সে তুলে নিয়েছে তার সারা গায়ে। যেন উদাসীন শরীরে ভরে গেছে সমস্ত অনুভবের অজস্র উল্কি। পেনের নিব থেকে বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন নিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভাষার জন্মস্রোত—তবে এভাবেই আমরা লিখে এসেছি। দুঃখে, আনন্দে, বিষাদে, হিংসায়, সততায়, অসততায় আমরা তার গায়ে চেপে সত্যি থেকে মিথ্যের সব খেলা খেলেছি। কখনো সাজিয়ে রেখেছি, কখনো ধুলো ঝেড়েছি কখনো বা দুমড়ে-মুচড়ে আবর্জনায় ফেলে দিয়েছি—সে শব্দ করেনি। আজ তাকে আমরা বাতিলও করে দিতে পারি তার সারা গা ফাঁকা রেখে প্রতারকের মতো চলে যেতে পারি। এত এত সত্যি জীবনের দেয়ালা সে দিনের পর দিন ভরে রেখেছে তবু তাকে কাগজের ফুল বলে কখনো বুঝিয়েছি সে নকল। আমরা ব্যবহারকারী সে ব্যবহৃত ফলে একতরফা এই আধিপত্যের খেলায় সে নিশ্চুপ রয়ে গেছে।
যাই হোক বন্ধুরা ভাবছেন জড়কে নিয়ে এত কিসের আদিখ্যেতা। তবে ঘন বৃষ্টিতে যখন ঘরের সামনের মনের নদীতে কবিতা লেখা কাগজ নৌকা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, যখন অনেক অনেক পুরনো চিঠি দাদু দিদিমার বাক্স থেকে ফিরে আসে, যখন আকাশে ঘুড়ি ওড়ে, যখন খবরের কাগজ মুড়ে তেলেভাজা আসে তখন আদিখ্যেতারাই জীবন হয়ে ওঠে।
এই যে যান্ত্রিক উপায় তার সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি নেই ফলে এই মনের নির্ভরযোগ্য উপাদান সে শেষ অবধি হতে পারবে কী প্রশ্ন জাগে! কাগজ আসলে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করে।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনের হান সাম্রাজ্যের চাই লুন প্রথম কাগজ তৈরি পদ্ধতিটি নিয়ে আসেন মালবেরি গাছের আঁশ, কাপরের টুকরো এবং আরো কিছুর মিশ্রণের মাধ্যমে। এর আগে চীনে বাঁশের গায়ে এবং সিল্কের কাপড়েই লেখার চল ছিল তবে একটি ভারী দ্বিতীয়টি দামি এই কারণে আস্তে আস্তে বিকল্প কাগজের পথকেই বেছে নেওয়া হলো সাধারণ অভ্যাসের জন্য। এরপর তালাশের যুদ্ধে দুই চীনা বন্দী হিসেবে গৃহীত হলে ইসলাম সাম্রাজ্যের মাধ্যমে প্রধানত কাগজের প্রসার শুরু হয়—যদিও এই গল্পের ভিত্তি সঠিক কিনা তা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে! এর কিছু পর থেকেই সমরখন্দে কাগজ তৈরি শুরু হয়ে যায়। এভাবেই ত্রয়োদশ শতকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে কাগজের সম্প্রসারণ শুরু হতে থাকে।
১৮৪৪ সালে অবশ্য চার্লস ফিনার্টি ও এফ জি কেলার নিজস্ব উদ্যোগে কাঠের আঁশ ব্যবহারে কাগজের উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হন। প্রাচীন ভারতে আবার প্রত্যক্ষভাবেই গাছের বাকল ও পাতার ব্যবহার চলত। এই থেকে পত্রকথার আগমন। যদিও ধাতুর ফলকে, কাঠের ফলকে, দেওয়ালে লেখার প্রচলন ছিল। তবে নিয়মিত অভ্যাসে তালপাতা, নারকেল গাছের খোসা ও পাতা, কলাপাতা তথা ভূর্জপত্রেও লেখার প্রচলন ছিল। কাগজ শব্দটি আরবি শব্দ ফলে এটা ধারণা করাই যায় তালাশের যুদ্ধের গল্পটির ঘটনা সত্যিও হতে পারে। তবে চীন এক্ষেত্রে খ্যাতির জায়গা পেলেও একটু শৈথিল্য থাকে কারণ পেপার শব্দটির আগমন প্রাচীন মিশরের প্যাপিরাস নামক লেখার বস্তু থেকে। মনে করা হতো সাইপ্রাস প্যাপিরাস গাছের অংশের ব্যবহার থেকেই এর আগমন পদ্ধতি। পার্চমেন্টের মধ্যেও লেখার বিশেষ আয়োজন ছিল; ভেড়া, ছাগলের লোমের থেকেও এই পার্চমেন্ট প্রস্তুত করা হতো। এই পার্চমেন্টের আরো সূক্ষ্ম বিকল্প ছিল ভেলাম শিশুপশুদের দেহের লোম দিয়ে তৈরি হতো। বর্তমানে অবশ্য পদ্ধতি অনেক অনেক উন্নত। ছেঁড়া কাপড়, বাঁশ, ঘাস, আঁশ জাতীয় মণ্ডের প্রস্তুতির মাধ্যমে কাগজ তৈরি হয়, এবার সেই উপাদান স্থান ভেদে পদ্ধতি ভেদে ভিন্ন। কোথাও গাছের আঁশ, কোথাও কাঠের গায়ের আঁশ এবং বর্তমানে বিশেষ বিশেষ মেশিনের মাধ্যমে লঘু থেকে উন্নত পাতলা থেকে মোটা বিভিন্ন ধরনের কাগজ প্রস্তুত করা হয়।
কাগজ কিভাবে এলো তার থেকেও যেটা খুব গুরুত্বের সেটা হলো কাগজকে যেন ভুলে না যাই। কারণ আমাদের কাগুজে প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে তবু অনুভব করলে ভালো যে কাগজ আসলে অস্তিত্বে ভরা, ছোঁয়ায় সে শব্দ করে, অক্ষরে সে আলোকিত, আটক করে রাখলে সে নিশ্চুপ—এত নির্বিবাদী কৈফিয়তহীন একটা স্বপ্নের শূন্য ক্যানভাসকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
আরো পড়ুন
শেষ যখন শুরুর জন্য পাগল