শেষ যখন শুরুর জন্য পাগল

  • তানিয়া চক্রবর্তী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

...and then, I have nature and art and poetry, and if that is not enough, what is enough?

এই প্রশ্ন যাঁর মনে জেগেছিল তিনি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। যিনি নিজে খাবারের ব্যাপারে অতিরুচি পছন্দ করতেন না। যিনি নিজে রাস্তার মসৃণ দিক দিয়ে চলা পছন্দ করতেন না? তার মনে “যথেষ্ট” এই শব্দের প্রকৃত অর্থ বোঝার এত তাগিদ এসেছিল? ভাবতে অবাক লাগে তাই না! তাই কেউ বলেছেন যে আত্মহত্যা আত্মহত্যা নয় সেটা যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ। এবার প্রশ্ন, এই ওষুধ কার প্রয়োজন—যে নিজে লড়তে পারছে না, দুর্বল হয়ে গেছে তার? নিজে ডিপ্রেশনে ছিলাম বহুদিন, ভুলভাল চিন্তা এসেছে, তাদেরকে সৌভাগ্যক্রমে অতিক্রম করে এসেছি। আর সত্যি বলতে কী এর থেকে বেরিয়ে আসার সব থেকে বড় পথ ব্যক্তি নিজেই, যদি ভাগ্যক্রমে তার মনের কাছাকাছি কাউকে সে পায় তাহলে ভালো। তবে মন তখন এত অবুঝ ও জটিল থাকে এ ধরনের সঙ্গকেও ব্যক্তির বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। তাই মনোবিদের প্রয়োজন হয় তবু বলব, “সেলফহিলিং ইজ দ্য বেস্ট।”

বিজ্ঞাপন

“I am a noun in your life only a verb in mine...” এই লেখাটি তার একটি ছবির ক্যাপশনে ব্যবহার করেছেন তিনি; তিনি মানে সদ্যপ্রয়াত সুশান্ত সিং রাজপুত। সামনে পাহাড় ঘেরা সূর্যের নিভন্ত আলো আর তার সামনে দুহাত ভরে এক শিল্পী ।

বিজ্ঞাপন

আসলে বেঁচে থাকা ও মৃত্যু দুটোই স্বাভাবিক কিন্তু বেঁচে থাকাকে আমরা বেশি স্বাভাবিকভাবে নিই কারণ তার প্রক্রিয়াকরণ দৃশ্যমান কিন্তু যখন মৃত্যু তথা বিযুক্তিকরণ হয় তখন সেই উত্তরহীন রহস্য—প্রশ্ন ও হাহাকার দুটোই আনে, এটা অস্বাভাবিক নয়।

আগে ভাবছিলাম সবাই এতকিছু কেন বলছে? তারপর অন্যভাবে ভাবলাম...মানুষ সংবেদনশীল...সে শুধুই সিনেমা দেখতে যায় কী...তার মনের ব্যবহার করতে যায়...তাই তো স্ক্রিনে পছন্দের চরিত্র দেখে সে উত্তেজিত হয়...তাই তো ভক্তের জন্ম হয়! ফলে তার নিজে থেকেই অধিকার জন্মায় কথা বলার...অবশ্যই তা যদি রুচিহীন অমানবিক হয় তার সপক্ষে যুক্তি আসে না কোনোভাবেই...তবে মানুষ বলুক আর না বলুক...কিছু করতে উপায় না থাকা মানুষের বলা ছাড়া উপায়? সে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেভাবেই বলি...আর এই যে ডিপ্রেশন নিয়ে কথা শুনছি....ইনি তো নায়ক...সত্যি কী সব ভালোবাসা সব পাশে পাওয়া মানুষদের আমরা Allow করতে পারি...আজ যারা ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছেন বেঁচে থাকাকালীন ও জানলেও কী তাদের Allow করত...এই একক মুহূর্তগুলো এত জটিল যে ভালোবাসতে আসা সদুপদেশ দেওয়া মানুষদের সেইসময় হয়তো পীড়াদায়ক মনে হয়।

নেতিবাচক পরিস্থিতি সর্বত্র রয়েছে তবে একথা সত্যি তার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা সকলের সমান নয়। সাহিত্যে, শিল্পে, বহুক্ষেত্রে মানুষ মাত্রাতিরিক্ত অপমানিত হয়; যে সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব আড়ালে উচ্চ প্রশংসা করেন তারাই সময়ে নিশ্চুপ থাকেন, কেউ কেউ অস্তিত্বহীনতা, কেউ কেউ হিংসা, কেউ কেউ রাজনীতির স্বীকার হন। নারী-পুরুষ উভয়েই সমান আঘাতপ্রাপ্ত হন। ফলত এই বাস্তবিক জেতাকে জেতা ভেবে ফেলে বেঁচে থাকলে কষ্টের আধিক্য বেশি হয়ে যায় পরবর্তী লড়াইতে দুর্বলতা আসে। তাই এই বিষাদের জন্মমুহূর্ত থেকেই নিজেকে নিজেই সামলে নেওয়া জরুরি। মন কাকে সেই মুহূর্তে নেবে কেবল মনই জানে....কোনো মুহূর্তকেই এক সূত্রে বিচার করা যায় না কারণ কোনোকিছুই, কোনোকিছুই এত লঘু নয়! আর সকলে পড়ুয়া, বোধযুক্ত না-ই হতে পারে....সাধারণের প্রকাশ হয়তো লঘুভাবেও হয় কখনোসখনো... আমাদের বোধ পছন্দের যারা নয় তাদের থেকে দূরত্ব রাখি...অসম্মানে কী কাজ!

আসলে একটা মানুষকে সুস্থ উজ্জ্বল দেখলে কিছুতেই মানুষ তার অসহায়তাকে বোঝে না...ফলে তার প্রতি অন্য সব অনুভূতি জন্মালেও তার ক্রাইসিস সম্পর্কে সচেতন হয় না..এটা ভুল হলেও এটাই হয়ে আসছে।

পারিবারিক ঘনিষ্ঠ মৃত্যু দেখেছি, অনেক পরিচিতদের মৃত্যু দেখেছি। কিন্তু এই নায়ক তথা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু দূরত্বের হয়েও কেন এত নাড়িয়ে দিল কারণ তার হাবভাব, ভঙ্গি সব যেন ঘরের ছেলের মতো। অনেকে বলতেই পারেন এই শোক কদিনের? শোক কদিনের হয়? নিজের বাবা-মায়ের মৃত্যু হলেও সন্তান সেই শোক কিছুদিন পরে কাটিয়ে ওঠে কিন্তু যখন যেটা হচ্ছে তার গভীরতা সেটা এত মূল্যহীন নয়। এই এত প্রশ্ন তার মৃত্যু নিয়ে আসলে তো জীবনের প্রতি প্রশ্ন। হ্যাঁ, কিছু মানুষের কাছে হতে পারে আমোদের বিষয়—তবে বহুমানুষের কাছে অনুভূতিভিত্তিক।

এই কিছুমানুষের নেতিবাচক বিষয়টি যতদিন সভ্যসমাজ থাকবে ততদিনই থাকবে। তাঁর মৃত্যু খুনের মাধ্যমে হয়েছে না আত্মহত্যা তার চেয়েও বড় কথা দুই ক্ষেত্রেই সে জীবন থেকে স্বাভাবিক বিদায় নেয়নি। আসলে একজন স্টার যে সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, দূর থেকে যখন সে হাত নাড়ায় আর মানুষ তাতেই পাগল হয়ে যায়! কিন্তু যখন সে পথের বিড়াল, কুকুরকে আদর করে, পাখিকে খাওয়ায়, যখন সে আর্তদের জন্য অর্থ দান করে এবং বলে প্রয়োজনের থেকে সে অনেক বেশি উপার্জন করে। আর এই প্রয়োজনটা মানুষের নিজের হাতের তখন সে স্টারের সঙ্গে সঙ্গে একজন অন্তরাত্মার মানুষ হয়ে যায়। জীবনকে একরৈখিকভাবে দেখা খুব কঠিন। মনে পড়ে কবি হাই জি-র আত্মহত্যার কথা। আরো অল্পবয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। যাঁকে এখন চীনের বিখ্যাত কবি মানা হয়। আসলে সময় এবং সময়ের বোধ কিভাবে কার্যকরী হবে ব্যক্তির ওপর তা বোঝা মুশকিল। তবে সময়ের প্রতিটা কোণেই ফাঁদ থাকে—আমরা ভাবি আমরা শ্রেষ্ঠ আমরা মানুষ, সেই আমরাও আসলে শিকারীর শিকার বাঁচিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষার প্রতিষ্ঠা দিতে লড়ে যাচ্ছি। আমাদের আশেপাশে সত্যি মিথ্যের মেলা, ন্যায়-অন্যায়ের দোটানার পরিবেশ সেখানে নিজের শর্তে বাঁচা আসলে অঙ্গীকার আর সেই অঙ্গীকার বাঁচিয়ে রাখা হলো জেদ।

জীবন এমন একটা জায়গা যেখানে সব শেষ শুরুর দিকে যাওয়ার পথ রাখে—মৃত্যু তা নয়। কেউ যদি নিজে মৃত্যু গ্রহণ করে সেটা তার নিজের অধিকার ও সিদ্ধান্ত তবু ভাবা উচিত একদিন তো মরবই ফলে দেখি না কী হয়। এখানে ভালো এবং মন্দ দুটোই শূন্য। আমরা ইন্দ্রিয়ে অধ্যাসে বাঁচি তাই প্রতিমুহূর্তে প্রেক্ষক হতে কেউ যদি শিখে যায় সেই রাজা—যে এই ইলিউশনে জিতে যায় অর্থাৎ বাস্তবে তার রাজত্ব নিয়ে ভাববার কিছু নেই। ভাবলে বিপদ যে খুব তা নয় তবে ঐ এক একটা স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে চলে যাওয়া যার ফলে এই জীবন নামক সার্কাসের পুরো ম্যাজিকটাই মিস...