সিডনি শনবার্গের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার

‘আমার পাইপ আর তামাকের কথা ভুলে গেছি’

  • ভূমিকা ও অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

পাইপমুখে শেখ সাহেব—এই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সিগনেচার ফটোগ্রাফ। যারা তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, পাইপ ছাড়া তাঁর এ ধরনের ফটোগ্রাফ অসম্পূর্ণই মনে হবার কথা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা যখন তাঁকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, গাড়িতে ওঠার সময় বঙ্গবন্ধুর মনে হলো পাইপ আর তামাক সাথে নেননি।

একাত্তরের বন্ধু সিডনি এইচ শনবার্গ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী; তিনি তখন নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি। ২৭ মার্চ যেসব বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে তুলে নিয়ে সরাসরি তেজগাঁও এয়ারপোর্টে অপেক্ষমাণ উড়োজাহাজে উঠিয়ে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয় শনবার্গ তাদের অন্যতম। সিডনি পাকিস্তানি স্বৈরাচার ও জান্তার নির্যাতন পৃথিবীর কাছে তুলে ধরেন। তার জন্ম ১৭ জানুয়ারি ১৯৩৪ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে, মৃত্যু ৯ জুলাই ২০১৬ নিউ ইয়র্কে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত। একাত্তরের বাংলাদেশ নিয়ে তার কয়েকটি স্মরণীয় প্রতিবেদন : ‘বিদ্রোহ দমাতে সৈন্যরা কামান দাগাচ্ছে’, ‘পূর্ব পাকিস্তানে কামানের বিরুদ্ধে লাঠি ও বল্লম’।

বিজ্ঞাপন

১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সিডনি শনবার্গের ‘তিনি তাঁর গ্রেফতার ও আটকের কাহিনী বলেছেন’ শীর্ষক সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো:

 

বিজ্ঞাপন

তিনি তাঁর গ্রেফতার ও আটকের কাহিনী বলেছেন


তিনি তার ক্রন্দনরত স্ত্রী ও সন্তানদের বিদায়ী চুম্বন করলেন, তারা যে কথাটি খুব ভালো করেই জানতেন, তিনি সে কথাটিই বললেন হয়তো তিনি আর ফিরবেন না। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে খোঁচা দিয়ে সিঁড়িপথে নামাচ্ছে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেছন থেকে আঘাতও করেছে। তিনি তাদের জিপ পর্যন্ত পৌঁছালেন, তারপর হঠাৎ তার অভ্যাসজনিত প্রতিক্রিয়া ও স্পর্ধা থেকে বলে উঠলেন, ‘আমি আমার পাইপ আর তামাকের কথা ভুলে গেছি। আমাকে অবশ্যই আমার পাইপ আর তামাক আনতে হবে।’

সৈন্যরা ধাক্কা খেল, তাদের হতবুদ্ধি অবস্থা, কিন্তু তারা তাকে এসকর্ট করে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলো, সেখানে তার স্ত্রী পাইপ আর তামাকের থলে তার হাতে তুলে দিলেন। তারপর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে সাড়ে নয় মাস কারারুদ্ধ রাখতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেল। তার বর্ণনার এটি একটি অংশ, শেখ মুজিবুর রহমান তার গ্রেপ্তার কারাবাস ও মৃত্যু থেকে কোনোভাবে বেঁচে আসার এবং সপ্তাহ আগে তার মুক্তির কাহিনী এই প্রথম বর্ণনা করলেন।

কিছুটা তিক্ততা, কখনো তার সৌভাগ্যের জন্য হাসি, নবঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিরুদ্বেগ হয়ে স্বচ্ছন্দ ইংরেজিতে হাতে গোনা আমেরিকান সংবাদপত্রের ক’জন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাকে গ্রেপ্তারকারী সাবেক প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক দাপ্তরিক আবাস ভবনের বসার ঘরে কৌচে হেলান দিয়ে ২৫ মার্চ রাতের শুরু থেকে কী ঘটেছে বলতে শুরু করেন। ওদিকে ইয়াহিয়া খান নিজেই এখন পশ্চিম পাকিস্তানে গৃহবন্দি।

তিনি বললেন, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের তাকে হত্যা করে বাঙালিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা তিনি জানতে পেরেছিলেন।

‘যখন আমি বাসা থেকে বেরিয়ে আসব। তারা আমার গাড়ির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করবে এবং তারপর জানিয়ে দেবে যে, বাঙালি উগ্রপন্থীরা কাজটা করেছে এবং সে কারণেই সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে এবং আমার জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আমার বাড়িতে আমার রুমেই থাকব; আমার বাড়িতে আমাকে হত্যা করার সুযোগ দেব যাতে সবাই জানতে পারে তারাই আমাকে হত্যা করেছে আর আমার রক্ত আমার জনগণকে শুদ্ধতা এনে দেবে।’

সেদিন ২৫ মার্চ আসন্ন সেনা আক্রমণের খবর তীব্র হয়ে উঠছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন এবং শোষণের অবসান ঘটিয়ে অধিকতর জনসংখ্যাবহুল পূর্বাঞ্চলকে মুক্ত করতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এই সেনা আক্রমণ।

শেখ মুজিব তার বড় ছেলে কামাল ও দুই মেয়েকে অন্যত্র লুকোতে পাঠিয়ে দিলেন। কনিষ্ঠ ছেলে রাসেলকে নিয়ে তার স্ত্রী তার পাশে রয়ে গেলেন, ঢাকার ধানমন্ডিতে তাদের সাধারণ দোতলা বাড়ি ছেড়ে যেতে তিনি অস্বীকার করেন।

তাদের কারোরই জানা ছিল না যে, তাদের মধ্যম পুত্র জামাল তখনও বাড়িতে নিজ রুমে ঘুমোচ্ছে। রাত ১০টার মধ্যে শেখ মুজিব জেনে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেসামরিক জনগণের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। কয়েক মিনিট পর বাহিনী তার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। কাছাকাছি কোথাও একটি মর্টার সেল বিস্ফোরিত হয়। এধরনের আক্রমণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে তিনি কিছু গোপন পরিকল্পনা করলেন। রাত সাড়ে ১০টায় তিনি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি গোপন সদর দপ্তরে ফোন করে তার নিজস্ব লোককে একটি শেষ বার্তার ডিকটেশন দিলেন, যা পরে রেকর্ড করা হয় এবং গোপনীয় ট্রান্সমিটারে সম্প্রচার করা হয়। সম্প্রচারের সার কথা হলো, সেনা আক্রমণ তাদের প্রতিহত করতে হবে, তাদের নেতার যাই ঘটুক, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার কথাও বলেছেন।

শেখ মুজিব জানালেন, এই বার্তা পাঠানোর পর প্যারা মিলিটারি ইউনিট পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের লোকদের এবং তার প্রহরায় থাকা তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের লোকদের নির্দেশ দিলেন। রাত ১১টায় সারা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হলো এবং খুব দ্রুত আক্রমণ তুঙ্গে উঠে গেল। মধ্যরাত থেকে রাত ১টার মধ্যে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবের বাড়িতে গুলি করতে শুরু করল। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ওপরতলায় ড্রেসিং রুমে ঠেলে দিলেন এবং যখন মাথার ওপর দিয়ে বুলেট ছোটা শুরু করল, তারা মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে রইলেন। সৈন্যরা তখন দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকল, যে প্রহরী তাদের ভেতরে যেতে বাধা দিচ্ছিল, তাকে গুলি করে হত্যা করে ঝড়োগতিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়।

শেখ মুজিব ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে তাদের মোকাবেলা করে বললেন : ‘গুলি বন্ধ করো! গুলি বন্ধ করো! তোমরা গুলি করছো কেন? যদি গুলি করতে হয় আমাকে করো; এই তো, আমি এখানে, আমার মানুষদের, আমার সন্তানদের কেন গুলি করছো?’

আরেক পশলা গুলির পর একজন মেজর তার লোকদের থামায় এবং আর গুলি না করার নির্দেশ দেয়।

মেজর শেখ মুজিবকে জানায়, তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে; তার অনুরোধে মেজর তাকে বিদায়ী কথা বলার জন্য কয়েক মুহূর্তের সুযোগ দেয়। তিনি পরিবারের সব সদস্যকে বিদায়চুম্বন দেন এবং তাদের বলেন, ‘তারা আমাকে মেরে ফেলবে, তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা নাও হতে পারে। কিন্তু আমার মানুষেরা কোনো না কোনো দিন স্বাধীন হবে আর আমার আত্মা তা দেখে সন্তুষ্ট হবে।’

তাকে জাতীয় পরিষদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়, ‘সেখানে আমাকে বসতে চেয়ার দেওয়া হয়। তারপর তারা আমাকে চা সাধে।’

তিনি ঠাট্টার স্বরে ঘটনাটি মনে করে বললেন, ‘আমি বললাম, চমৎকার! চমৎকার অবস্থা! চা খাওয়ার জন্য এটাই তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।’ কিছুক্ষণ পর তাকে সামরিক সেনানিবাসের অভ্যন্তরে একটি জায়গায় অন্ধকার ও নোংরা একটি কক্ষে নেওয়া হয়। তার ছয়টি দিন কেটেছে এই কক্ষে আর মধ্যরাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের বাড়ির একটি কক্ষে। যে সামরিক নিপীড়নে হাজার হাজার বাঙালি নিহত এবং অত্যাচারিত হয়েছে, তার জন্য বাঙালিরা টিক্কা খানকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী মনে করে।

শেখ মুজিব বললেন, ১ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে হাজার মাইল দূরে উড়োজাহাজে তাকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে মিয়ানওয়ালি কারাগারে কনডেমড সেলে। তিনি পরবর্তী নয় মাস কাটিয়েছেন মিয়ানওয়ালিসহ পর্যায়ক্রমে লায়ালপুর ও শাহিওয়ালের কারাগারে, সবগুলোই পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে। সামরিক সরকার ১২টি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে, যার ৬টির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’।

শেখ মুজিব, যিনি নিজেও আইনজীবী, জানতেন তার অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কাজেই কৌশলগত বিলম্বের চেষ্টা চালালেন। তিনি হেসে বললেন, ‘আমিও তাদের সঙ্গে একটি খেলা খেলছিলাম, আমি কিছু সময় পেতে চেষ্টা করছিলাম।’

বড় আইনজীবীর দাবি
তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে খ্যাতিমান এবং সব দলের শ্রদ্ধেয় আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে তার জন্য নিয়োগ করার দাবি জানালেন। শেষ পর্যন্ত ব্রোহিকে নিয়োগ দেওয়া হলো এবং তিনি প্রতিপক্ষের হয়ে লড়াই করার প্রস্তুতি নিলেন। কয়েক মাস পর লায়ালপুরে আদালত খোলা হলো, শেখ মুজিব হঠাৎ মত পাল্টালেন, তিনি জানালেন তার আইনজীবীর কোনো প্রয়োজন নেই, যাতে ব্রোহিকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নতুন মার্শাল ল অর্ডার জারি করলেন, তাতে বলা হলো, শেখ মুজিব চান বা না-ই চান, তার জন্য আইনজীবী থাকতে হবে। শেখ মুজিব বললেন, ‘দেখলেন তারা কেমন করে আমার অধিকার সংরক্ষণ করল—আসলে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য তারা একটি সার্টিফিকেট চাচ্ছিল।’

বিচার শেষ হলো ৪ ডিসেম্বর—পূর্ব পাকিস্তান সংকট থেকে সৃষ্ট ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের’ দ্বিতীয় দিন—যে যুদ্ধ শেষ হলো ‘ভারতের বিজয়’ এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। শেখ মুজিব বললেন, ‘ইয়াহিয়া সামরিক আদালতের সব সদস্যকে রাওয়ালপিন্ডিতে ডাকলেন এবং দ্রুত তাদের রায়ের খসড়া সম্পন্ন করতে বললেন, কিন্তু তারপর যুদ্ধের কারণে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।’

বঙ্গবন্ধু ও ফিদেল ক্যাস্ত্রো

পুরোদস্তুর যুদ্ধের মধ্যে এই রায় কিছুটা হাস্যকর শোনালেও, শেষ পর্যন্ত কখনো তা আর ঘোষিত হয়নি, তবে ৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে মিয়ানওয়ালিতে স্থানান্তর করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের আগের দিন শেখ মুজিবের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা ছিল তাকে ঝুলিয়ে দেওয়া; তিনি তা পরদিন সকালে জেনেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির নিজ জেলায় মিয়ানওয়ালি কারাগার। কারাগারের আর সব কয়েদি এই জেলার, ১৫ ডিসেম্বর কয়েদিদের বলা হয় বাঙালিরা নিয়াজিকে হত্যা করেছে, পরদিন সকালে যখন কারাগারের দরজা খোলা হবে তাদের কাজ হবে শেখ মুজিবকে হত্যা করা। তারা সোৎসাহে সম্মতি জানায় তিনি কথা বললেন।

তাকে হত্যা করার জন্য নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ কারা তত্ত্বাবধায়ক সেলের তালা খুললেন। শেখ মুজিব জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কি ফাঁসিতে ঝোলাতে নিয়ে যাচ্ছেন?’ তিনি তার সেলের পাশেই কারা কর্মচারীদের কবর খনন করতে দেখেছেন (তারা বলেছে ভারতীয় বিমান আক্রমণ হলে তাকে রক্ষা করার জন্য পরিখা খনন করা হয়েছে।)

বেশ উদ্দীপিত কারা তত্ত্বাবধায়ক কয়েদিকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাকে ফাঁসি দিতে নেওয়া হচ্ছে না। শেখ মুজিব সন্দিহান হলেন। ‘আমি তাকে বললাম, “আমাকে যদি ফাঁসি দিতে হয় তাহলে আমাকে শেষ প্রার্থনা করার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন”।’ তত্ত্বাবধায়ক শেখ মুজিবকে টানতে টানতে বললেন, ‘না, না সময় নেই, আপনাকে অবশ্যই আমার সঙ্গে আসতে হবে।’

কারাগার থেকে বেরোতে বেরোতে তত্ত্বাবধায়ক তাকে কারাভ্যন্তরের পরিকল্পনাটির কথা বললেন। তত্ত্বাবধায়ক কয়েদিকে প্রায় এক মাইল দূরে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, তাকে দুদিন নিজ বাড়িতে রাখলেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে, দাপ্তরিক মহলে ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিরাজ করছে।

১৮ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক শেখ মুজিবকে বললেন, ‘তার অবস্থানের তথ্যটি ফাঁস হয়ে গেছে, তাকে এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে।’ এই কর্মকর্তা, যিনি জেলাতে পুলিশেরও সুপারিনটেনডেন্ট, এই বাঙালি নেতাকে বেশ ক’মাইল দূরে একটি খালি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তিনি সেখানে নয় দিন ছিলেন।

সৈন্যরা তত্ত্বাবধায়কের কাছে তিনি কোথায় জানতে চাইলে জানেন না বলে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ককে বলেন, শেখ মুজিবকে নিয়ে লুকোচুরির কোনো কারণ নেই, ভয়েরও কারণ নেই। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো যিনি বদনাম হওয়া জেনারেলদের কাছ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, তিনিই শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত করতে ও কথা বলতে চেয়েছেন।

শেখ মুজিব বেরিয়ে এলেন এবং তখনই তাকে উড়োজাহাজে রাওয়ালপিন্ডি নেওয়া হলো, সেখানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হলো। কয়েক দিন পর পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ভুট্টো সাহেব, যিনি পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান এবং নিপীড়নে সেনাবাহিনীর সহযোগী ছিলেন, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তিনি আমাকে বললেন, তিনি তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভুট্টো আপনি এখানে কী করছেন?’

শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টোর ক্ষমতায় আরোহণের খবরটি তিনি জানতেন, তবে তার সঙ্গে একটু তামাশা করলেন। তার জবাব, ‘আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং একই সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’, যা শেখ মুজিবের মতে, ‘একটি বিস্ময়কর পরিস্থিতি।’

শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টো তাকে বলেছেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় বলেছেন, তার আফসোস রয়ে গেছে যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারেননি, ‘এই একটি কাজ’ শেষ করার জন্য তিনি তাকে অনুরোধ করেন।

ভুট্টো শেখ মুজিবকে আরো বলেন, সৈন্যরা কাগজপত্রে তারিখ পিছিয়ে কাজটা করতে চেয়েছে, যাতে মনে হয় কেবল বাস্তবায়নটাই তার সময়ে হয়েছে। ভুট্টো তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ মুজিব বলেন, ভুট্টো যে কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তার কারণটি প্রধানত রাজনৈতিক। ভুট্টো মনে করেছেন যদি বাঙালি নেতাকে হত্যা করা হয়, তাহলে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করা প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করবে। আর পাকিস্তানি সৈন্যদের অধিকাংশই এসেছে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে—তারা ভুট্টোকে দোষারোপ করবে এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে।

শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি তাকে বললাম, সবার আগে জানতে চাই আমি কি মুক্ত না তা নই? যদি মুক্ত হই, আমাকে যেতে দিন, যদি তা না হই, কথা বলতে পারব না।’

তিনি ভুট্টোকে উদ্ধৃত করে বললেন, ‘আপনি মুক্ত, তবে আপনাকে যেতে দেওয়ার আগে আমার কয়েকটি দিন সময় চাই।’ মুক্তির প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরও শেখ মুজিব বললেন, তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলেননি। অন্য একটি বিষয়ে কথা বলার সময় ভুট্টো যখন বললেন, আইন ও ঐতিহ্য অনুসারে দুটি অংশ এখানে সংযুক্ত, শেখ মুজিব তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল—কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলকে কখনো সম্মান করা হয়নি।

বললেন, ‘বেশ, পাকিস্তান যদি এখনো এক দেশ হয়ে থাকে, তাহলে আপনি প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নন, আমি।’

৭ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট তৃতীয় ও শেষবারের মতো শেখ মুজিবকে দেখতে যান। বাঙালি নেতা বললেন, তিনি তাকে বলেছেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে, আর দেরির সুযোগ নেই, হয় ছেড়ে দিন, নতুবা আমাকে হত্যা করুন।’

শেখ মুজিব বললেন, তার কথার জবাবে ভুট্টো বলেছেন, এত স্বল্প সময়ের নোটিশে ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়বে, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে লন্ডনে পাঠাতে সম্মত হলেন।

শেখ মুজিব বললেন, তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ভুট্টো তখনও বলছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক বন্ধন রক্ষা করার বিষয়টি যেন বিবেচনা করেন।