বঙ্গবন্ধুর ভিনদেশি ভক্ত অনুরাগীদের কথা
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখায় পাকিস্তানি কবিকে বেত্রাঘাত
বাংলাদেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানের কবি আহমেদ সালিম। পাঞ্জাবি ভাষায় কবিতা লেখেন। করেন ছাত্র ইউনিয়য়ের রাজনীতি—তার নেত্রী বর্তমান আওয়ামী-নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। সালিম পশ্চিম পাকিস্তানের এ হামলা মেনে নিতে পারছেন না। দুটো কবিতা লিখলেন। একটি ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক’ ও অন্যটি ‘সোনার বাংলা’ শিরোনামে। দুটোই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। ১৯৭১ সালের মে মাসের এক রাত। লাহোরের রাভি নদীর পাড়ে খিড়খানা এলাকার একটি বাসার সামনে এসে থামল পাকিস্তানি পুলিশের গাড়ি। দরজায় কড়া নড়ল—সালিমজী সালিমজী। ডাক পুলিশের।
এরপরের দৃশ্যে আমরা দেখি ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন আহমেদ সালিম। বক্তৃতা দিচ্ছেন। গ্রেফতারের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় তিনি বলেন, “সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখার জন্য পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করতে এলে তখন ৪ বছর বয়সী আমার বোনঝি জিজ্ঞেস করেছিল, মামাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন, তখন আমার বোন বলেছিল তোমার মামা জেনারেল ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছে। বোনঝিটি কবিতার মানে বোঝে না, তাই বলেছিল, ইয়াহিয়া মামার বিরুদ্ধে একটি কবিতা লিখতে পারত, ধরে নিয়ে যাওয়া কী প্রয়োজন। এই নিষ্পাপ শিশুর মন্তব্যের ভেতর বিচারের গভীর তাৎপর্য নিহিত। সামরিক আদালতে হাজির করা হলে বিচারক আমাকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তখন আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে পরবর্তী ছয় মাস আপনি ক্ষমতায় থাকবেন? আপনি কি জানেন শেখ মুজিব নিজেই একটা মহাকাব্য? এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিচারক আমাকে পাঁচটি বেত্রাঘাত করার আদেশ শাস্তিতে যোগ দেন।”
এমন ম্যাসাকার মেনে নিতে পারিনি, তাই ছুটে এসেছিলাম
পাকিস্তানের সাংবাদিক ওয়ারিস মীর। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় চলে আসেন বাংলাদেশে। ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যার ভয়াবহতা দেখে ক্ষুব্ধ তিনি এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন দৈনিক জং পত্রিকায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তার এক ব্রিগেডিয়ার বন্ধু, নাম আব্দুল আজিজ তাকে বললেন, “দেশের সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলি?” জবাবে ওয়ারিস মীর বলেন, “আমার ওই অর্থে কোনো দেশ নেই। যেখানেই নির্যাতন সেখানেই নির্যাতিতের পক্ষে দাড়ানোই আমার এবাদত।”
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবদানের জন্য পরে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মাননা দেয়। তার ছেলে হামিদ মীর, সংবাদপত্রে স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে ছুটে এসেছিলেন বাবার সম্মানের অনুষ্ঠানে। হামিদ মীরই তার বাবার বিষয়ে এসব কথা জানান।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর অফিসে একবাল আহমাদ
একবালের জন্ম ভারতের বিহারে ইরকি গ্রামে। ছোটবেলায় বাবাকে হারান। ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের সময় ভাইদের সাথে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। তিনি বুঝতেন জন্মভূমি থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার যাতনা। ছিলেন মার্কসবাদী। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত তিনি আলজেরিয়ায় ছিলেন এবং সেখানকার ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন যুদ্ধবিরোধী এক ফিলোসফার। আমেরিকায় খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ’৭১ সালের ১২ আগস্ট তিনি নিউইয়র্ক টাইমস অফিসে যান। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের হামলা নিয়ে লিখেছেন দুটো লেখা। তার কাছে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক রিচার্ড ক্লেন জানতে চান, “আপনার লেখাগুলো তো শেখ মুজিবের পক্ষে যাচ্ছে। আপনি তবু লিখছেন কেন? জবাবে একবাল বলেন, “শেখ মুজিব শোষিতের পক্ষে। আমি শোষকের বিরুদ্ধে। এটিই হচ্ছে সহজ হিসেব। সেদিন তাদের পাশে বসেছিলেন আরেক আমেরিকান সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক অ্যানি লোপার। তিনি একবালের এ কথা মুগ্ধ হলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবকে দেখতে এসেছিলেনে। এসব তথ্য অ্যানি লোপারই জানান তার বইতে।
অ্যানি লোপারের চোখে বঙ্গবন্ধু
অ্যানি লোপার একটি বই লেখেন বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে। বইটির নাম ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’। বইটিতে অ্যানি লোপার স্মৃতিচারণ করে বলেন, “১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়েছিল ঘরোয়া পরিবেশে। একবারও মনে হয়নি এত বড় একজন নেতার সামনে বসে আছি। বন্ধুসুলভ মুজিব নিজে চায়ের কাপ তুলে দিলেন আমার হাতে। এমন অসাধারণ মনের পরিচয় পাওয়া কঠিন। আমার সাংবাদিক জীবনে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছি, বহু নেতা-নেত্রীর সাথে সাক্ষাত করেছি, কিন্তু বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতো এমন সহজ-সরল মানুষ আর পাইনি। তিনি খুব আনঅফিসিয়াল ব্যবহার করতেন সবার সঙ্গে, এটি আমার মনে হয়েছে।”
রশীদ হায়দার জানান, আমেরিকায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা বই লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অ্যানি লোপার। তিনি লেখক হিসেবেও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য রিপোর্টও করেছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এ। রশীদ হায়দার তার সম্পাদিত বই ‘১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’-এ ‘রেমান, মুজিবুর রেমান’ শিরোনামে এক লেখায় বলেছেন , “১৯৭৯ সালে নিউইয়র্কে আশি বৎসরের এক বৃদ্ধা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন দেশ থেকে এসেছো? দেশের নাম, মহাদেশের নাম বলেও বৃদ্ধাকে দেশকে চেনানো গেল না, পরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হলে মহিলা স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন, oh! yes, yes, I remember, I remember, Your great leader was Reman, Mujibur Reman .
সুচিত্রা সেনের কাছে টাকা চাইলেন ঋত্বিক ঘটক
ঋত্বিক ঘটক সুচিত্রা সেনকে বলেন, “অন্নদাশঙ্কর রায় তো তোমার জ্যাঠা, তাকে জিজ্ঞেস করো, শেখ মুজিব কে? সুচিত্রা চুপ। ঋত্বিক বলেন, “শেখ মুজিব আমার ভাই। আমি ওইদেশ ছেড়ে চলে এসেছি। কিন্তু মুজিব আমার মতো বাঙালিদের জন্যই লড়ছেন।” আনন্দবাজারকে সাক্ষাতকারে সুচিত্রা সেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব বলেছিলেন। পরে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিচিত্র চিত্রিত সুচিত্রা’ বইতে এসব কথা জানান। সেই ঘটনা এমন, “সময় ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর, দুপুর। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের এক জায়গায় জটলা। অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন যাচ্ছিলেন গাড়িতে। দেখেন, পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এরা জড়ো হওয়া মানুষের কাছে হাত পাতছেন। আর একটা টুলে বসে গিটার বাজিয়ে বব ডিলানের গান গাইছে এক বিদেশি তরুণ। সুচিত্রা খেয়াল করলেন ঋত্বিকের পেছনে একটা ব্যানারে বড় করে লেখা : ‘বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য দান করুন, শেখ মুজিবের পাশে থাকুন।’ ব্যানারের পাশেই একটা বড় বাক্স, সেখানে রাস্তার মানুষ টাকা ফেলে যাচ্ছে।
সুচিত্রা এগিয়ে যেতেই “এলেই যখন, দুটো টাকা দিয়ে যাও” বলে ঋত্বিক ঘটক হাত বাড়ালেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে সুচিত্রা বললেন “ছিঃ দাদা। এমন করে বলছেন কেন? আমি কি দূরের কেউ?” বলেই কড়কড়া কয়েকটা ১০০ টাকার নোট দিলেন ঋত্বিকের হাতে। ঋত্বিক জানান, গিটার বাজানো তরুণটি মার্কিন সাংবাদিক স্টিভ টার্নার। কবি অ্যালান গিনসবার্গও কলকাতা এসেছেন। বারাসাত শরণার্থী শিবিরে গিয়েছে। ঋত্বিক সুচিত্রাকে বলেন, “আমরা ভীতু বাঙালি যারা বাংলার জন্য লড়ি না, মুজিব বাংলার বলী।”
বিমানে অশ্রুসিক্ত বঙ্গবন্ধু গাইলেন ‘সোনার বাংলা’, ঠিক হলো জাতীয় সংগীত
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরলেন। সেই দিন বিমানে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তিনি তার ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সঙ্গীত’ বইয়ে লিখেছেন, “১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে এলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশপররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। আমাকে দেখে শেখ মুজিব বলেন, ‘ব্যানার্জি, এখানেও আছেন!’ সেসময় ইন্দিরা-মুজিব টেলিফোনে আলাপ হয়।
এরপর রওয়ানা দিই বাংলাদেশের পথে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি উড়ছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাঁর চোখে জল। তিনি বললেন, ‘ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?” শশাঙ্ক জবাব দিলেন, “ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”