জনককে জানার সেরা কিছু বই
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল; কেউ কি জানত তার মুখের কথায় একদিন কেঁপে উঠবে হিমালয় থেকে সুন্দরবন? গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুল কিংবা কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে থাকতে রোগাটে সেই ছেলেটা কি কল্পনা করেছিল তার জন্য অপেক্ষা করছে একটা জাতি? কোনোটারই উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি, অদৃষ্ট বাঙালি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলা হচ্ছে। ব্রিটিশ বাংলায় বিভিন্ন অধিকার আদায়, পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার তৎপর ভূমিকা যে কোনো রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিকে বিস্মিত করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটা অংশের হাতে ধানমণ্ডির বাসভবনে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করার আগে অব্দি তার সামগ্রিক ধ্যান ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে জাতির মুক্তি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কিংবা মাওলানা ভাসানী যে কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় রেখেছিলেন; তার পূর্ণতা ঘটে তাঁর হাতে। আর এজন্যই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। জাতির পিতার জন্মের এই শতবর্ষ পরেও তাঁকে জানার জন্য আগ্রহ বাড়ছে বই কমছে না। প্রকাশ পাচ্ছে নানা নথিপত্র, লেখা হচ্ছে স্মৃতিকথা ও বই আর নির্মিত হচ্ছে ডকুমেন্টারি। বঙ্গবন্ধুকে জানার সেরা দশটি বই পরিচিত করিয়ে দিতেই আজকের আয়োজন।
১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী
কোনো মানুষ সম্পর্কে জানার সবচেয়ে বড় উপায় তাঁর চিন্তার সাথে পরিচিত হতে পারা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও চিন্তার একটা বড় অংশ ধরা পড়ে তার স্মৃতিকথাতে। ঘটনাটা ২০০৪ সালের। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই আসে পিতার জীর্ণপ্রায় চারটি খাতা। বস্তুত তা ছিল ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের লিখতে শুরু করা আত্মজীবনী। নিজের বংশ পরিচয়, শৈশব, শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কথা বিবৃত হয়েছে এই বইয়ে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, প্রাদেশিক মুসলিম লিগের অপশাসনের পাশাপাশি উঠে এসেছে নীতি এবং আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে জাতির জনকের সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে জানতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য দলিল এটি। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।
২. কারাগারের রোজনামচা
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে কারাগারেই কাটিয়েছেন ১৪ বছর। সেই ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো যেতে হয় অধিকার আদায় আন্দোলনের জন্য। পাকিস্তান আন্দোলনের পর তা যেন আরো চরমে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ অব্দি ছিলেন পাঁচ দিন। তারপর থেকে দফায় দফায় তাকে আটক ও কারাবন্দী করা হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেষবারের মতো কারাবন্দী হবার আগে ডাক দিয়ে যান স্বাধীনতার। পাকিস্তান সরকার যে তাকে নিয়ে ভীতিতে ছিল; তা স্পষ্ট।
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ অভিযাত্রাকে তুলে আনার দিনপঞ্জি কারাগারের রোজনামচা। পঙক্তিতে পঙক্তিতে ফুটে উঠেছে বাঙালির সার্বভৌমত্ব অর্জনের বিশ্বাস। বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় বইটি।
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি (দুই খণ্ড)
সম্পাদনা এবং প্রামাণ্যকরণ পরিষদে ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, গাজীউল হক, মুস্তাফা নুরউল ইসলাম, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং আশফাক-উল আলম। বাংলা একাডেমি থেকে ২০০৮ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত বইটি এখন অব্দি বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে পরিপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে শৈশব, কৈশোর এবং ছাত্রজীবনে কিভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেন—তার বর্ণনা যেমন আছে; তেমনি আছে মুজিবের নেতৃত্ব বিকাশের ইতিবৃত্ত।
প্রথম ভাগে ব্রিটিশ ভারতে মুজিবের প্রস্তুতি, দ্বিতীয় ভাগে সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলার আন্দোলন ও সংগ্রামের গল্পে নেতৃত্ব, তৃতীয় ভাগে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু, চতুর্থ ভাগে পাক কারাগার এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, পঞ্চম ভাগে রাষ্ট্রনায়কের আসনে এবং ষষ্ঠ ভাগে একটি সরল উপসংহার টানা হয়েছে। বাড়তি হিসাবে পরিশিষ্টে বিভিন্ন তথ্য-তত্ত্ব, আলোকচিত্র এবং চিঠির সংযোজন।
৪. ওঙ্কারসমগ্র
বঙ্গবন্ধুর প্রধান কিছু গুণের মধ্যে ছিল বাগ্মীতা। যেখানেই গিয়েছেন, বিন্যস্ত শব্দচয়ন এবং আবেগধর্মী বর্ণনায় মাতিয়ে তুলেছেন শ্রোতা সমাবেশকে। এরকম শতাধিক ভাষণ থেকে বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ ৬৭টি ভাষণের শ্রুতিলিপি আকারে সংকলিত করেছে—ওঙ্কারসমগ্র। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত বইটির শ্রুতিলিখন ও সম্পাদনার কাজটি করেছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। শুরু হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ ঢাকায় দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে আর শেষ হয়েছে ৮ মার্চ ১৯৭৫ সালে টাঙ্গাইলে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণের বিবরণী উঠে এসেছে ভাষণগুলোতে। এসেছে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির প্রচেষ্টা। দল, মত নির্বিশেষে যে কোনো বাঙালির কাছে ভাষণগুলো অন্যরকম তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিতে পারে।
৫. শেখ মুজিব আমার পিতা
এই বইটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার লেখা স্মৃতিকথামূলক আত্মজৈবনিক রচনাগ্রন্থ। রাজনৈতিক শেখ মুজিবের বাইরে এসে বইটিতে ধরা দিয়েছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের নানা অজানা তথ্য।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ এক অন্য যুগে প্রবেশ করে। অথচ সেই শৈশব থেকেই মানুষটা কেবল জনতার জন্য খেটেছেন। ঘুরেছেন জায়গায় জায়গায়। জেল খেটেছেন লম্বা সময়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার প্রত্যয় ছিল তার। ঘরোয়া বৈঠকেও উঠে আসত সেইসব স্বপ্নের কথা। সন্তানদের নৈতিকভাবে দৃঢ় করার জন্য মনোযোগ দিতেও ভুল করেননি; যার প্রমাণ আজকের প্রধানমন্ত্রী নিজেই। আগামী প্রকাশনী থেকে বইটি প্রথমবার প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। [চলবে]
৬. বাংলাদেশ
বইটি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশনা, সাক্ষাৎকার এবং দুর্লভ কতিপয় ছবির সংকলন। এছাড়া তাঁর উপাধিসমূহ, সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং কিছু ঐতিহাসিক দলিলপত্র যোগ করা হয়েছে। সম্পাদনায় ছিলেন আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, কাজী সিরাজুল ইসলাম এবং মো. জাহিদ হোসেন।
‘নেতাকে যেমন দেখিয়াছি’ দিয়ে শুরু হয়ে পরপর ৮টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। সবগুলোই বঙ্গবন্ধুর লেখা। পরবর্তী অংশে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়মূলক বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনায় বিবৃতি ও বক্তৃতা। ১৯৮০ সালের লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তচুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে দলিল হিসাবে; যা ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। বইটি প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি থেকে।
৭. বঙ্গবন্ধু: জননায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়ক
জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সম্পাদিত এই গ্রন্থটিতে আলো ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অজানা, আধা-অজানা বিষয়ে। একদিকে উন্মোচিত হয়েছে সংগ্রামী জীবনালেখ্য আর অন্যদিকে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা।
শামসুর রাহমান থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা অব্দি পাঞ্চাশের অধিক দেশবিখ্যাত ব্যক্তিদের চোখে ও স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুকে নির্মাণ করা হয়েছে পুনরায়। ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করাটা এই সময়ের দাবি হিসাবে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আগেই বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১০ সালে অন্বেষা থেকে প্রকাশিত হয় বইটি।
৮. শেখ মুজিব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পল্টনে নাজিমুদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা বাংলার ক্ষুব্ধ মানুষের মনকে আরো তাতিয়ে দেয়। সেই ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই দফায় দফায় চলে টানাপোড়েন। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সরকার গঠন, শিক্ষা আন্দোলন, সংবিধান প্রণয়ন, ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থ্যান এবং সবিশেষ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই দীর্ঘ যাত্রায় বঙ্গবন্ধু প্রতিটা সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।
শেখ মুজিব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম বইটি লিখেছেন মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি। উপসংহারসহ মোট নয়টি অধ্যায়ে লিখিত বইটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে তিল তিল যাত্রা এবং একজন রাজনৈতিক পাঞ্জেরি হিসাবে বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ভূমিকা স্পষ্ট করে দেখা দিয়েছে। কাকলী প্রকাশনী বইটি প্রথম প্রকাশ করে ১৯৯৬ সালে।
৯. গণপরিষদ ও সংসদে বঙ্গবন্ধু
জনতার সাথে বিভিন্ন সভা সমাবেশে আন্দোলনের পাশাপাশি সমান তৎপরতা ছিল পাকিস্তানি গণপরিষদ এবং স্বাধীন বাংলার সংসদে। গভর্নর ও গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা, পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক নীতি, সংসদের কর্মসূচির বাংলায় মুদ্রণ প্রভৃতি বিষয়ে তার মতামত ছিল সুদৃঢ়। ধর্মনিরপেক্ষতা, চাকুরি, ভাষা কিংবা মুদ্রার ব্যাপারেও তিনি সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানি নীতির।
দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক গণপরিষদ ও সংসদের ঘটনাবলি উঠে এসেছে আনু মাহমুদের কলমে। ন্যাশনাল পাবলিকেশন থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় বইটি।
১০. ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের জন্যই বিশেষ চক্রের কাছে তিনি শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। তার প্রমাণ আগরতলা মামলা দিয়ে শুরু। তারপর নানা সময়ে দেশের ভেতর কিংবা বাইরের, জটিল কিংবা নিষ্ঠুরতার। এই বইটি মূলত জনকের হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের অন্ধকারে আলো ফেলার প্রচেষ্টা। পাহার সমান দৃঢ়তা নিয়ে দণ্ডায়মান এক মহাপুরুষকে কিভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হলো তার তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আহত লেখক এক দশক ধরে অনুসন্ধান চালান ঘটনার গিঁট উন্মোচনে। বিভিন্ন ডকুমেন্টস, রেফারেন্স, নোট এবং সাক্ষাৎকার একত্রিত করেন বৃহৎ কলেবরে; যাতে উঠে এসেছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিক্রমা। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের লেখাটি চারুলিপি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে।