ঢাবির ফার্মেসি অনুষদের সাবেক দুই ডিনের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ

  • ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফার্মেসি অনুষদ

ফার্মেসি অনুষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফার্মেসি অনুষদের সাবেক দুই ডিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। অভিযোগটি কে করেছেন, চিঠিতে তার পূর্ণ নাম লেখা নেই।

১৫ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর পাঠানো অভিযোগের চিঠিটি ১১ মে গ্রহণ করে দুদক। অভিযোগের অনুলিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও জাতীয় প্রেসক্লাবেও পাঠানো হয়।

বিজ্ঞাপন

ওই চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের তহবিল থেকে টাকা আত্মসাতের মামলায় গত ২২ মার্চ শাহবাগ থানা পুলিশ অনুষদের অফিস সহকারী সাজ্জাদ হোসেন ও পিয়ন সুজনকে গ্রেফতার করে। দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয় হওয়ায় শাহবাগ থানার পক্ষ থেকে তা দুদককে অবহিত করে চিঠি পাঠানো হলে গ্রেফতারকৃত আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় পরিচালিত ফার্মেসি অনুষদের উন্নয়ন তহবিল ও ফার্মেসি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাংক হিসাব থেকে অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আব্দুর রহমানের সইয়ে বিভিন্ন সময়ে টাকা সরানো হয়। টাকা আত্মসাতের বিষয়টি নজরে আসার পর গত ১০ জানুয়ারি ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় নিয়মিত মামলার সুপারিশ করলে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া ডিনের দায়িত্ব শেষ হওয়ার দুদিন পরও ব্যাকডেট দিয়ে অধ্যাপক আবদুর রহমান ১৩ লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। সাবেক ডিন অধ্যাপক এস এম আব্দুর রহমান ২০২০ সালে করোনা শুরু হলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির নামে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে অনুদান বাবদ পাওয়া ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ সংক্রান্ত তথ্য জানেন গ্রেফতার হওয়া কর্মচারীরা।

বিজ্ঞাপন

গত চার বছরে অধ্যাপক রহমান ঢাকার বাড্ডায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ঢাকার উত্তরার একটি অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি। তার স্ত্রী একজন গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তার নামে রয়েছে ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোটি কোটি টাকার এফডিআর। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়ে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি-ফ্ল্যাট, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার এফডিআরসহ এসবের উৎস কী, তা এনবিআরের মাধ্যমে তদন্ত করলেই বের হয়ে আসবে। অনুষদের সদ্য সাবেক ডিন এস এম আব্দুর রহমানের সইয়ে টাকা উত্তোলন করা হলেও তাকে এখনও গ্রেফতার না করায় দুদকের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেন ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে।

গ্রেফতারকৃত দুই কর্মচারী অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নিকট আত্মীয় হওয়ায় তিনি ডিন থাকাকালীন তাদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে নিয়োগের আবেদনের রেফারি হিসেবে অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের সুপারিশ রয়েছে। এদের মধ্যে পিয়ন সুজন তার স্ত্রীর ভাগ্নে হওয়ায় তার মাধ্যমে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ঘুষ নিয়েছেন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও অধ্যাপক আব্দুর রহমান। পিয়ন সুজনের কোটি টাকার সম্পদের হিসাব নিলেই এর সত্যতা মিলবে।

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ডিন থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। ঢাকা শহরে তার ও তার আত্মীয়-স্বজনদের নামে-বেনামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি ও বাড়ি রয়েছে। এমনকি তার দুই মেয়ে বিদেশে থেকে পড়াশোনা করছেন, যা কোনোভাবেই তার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কয়েক বছর আগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সদস্য থাকার কারণে বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সপেকশনের নামে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকার আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন এবং তাদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন।

তাছাড়া ২০১৫ সালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির অধীনে সারাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর উৎপাদনের সার্বিক বিষয় তদারকির টিম লিডার থাকাকালীন অনেকগুলো কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়ার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার অনৈতিক সুবিধা ও ঘুষ নিয়েছেন। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জিঘাংসা চরিতার্থ করার ঘৃণ্য মানসে খোঁড়া অজুহাতে অনেক কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন। যদিও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে কোম্পানিগুলো আবার উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে।

অন্যদিকে অনুষদের সদ্য সাবেক ডিন অধ্যাপক আবদুর রহমান অধ্যাপক ফারুকের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে দুই কর্মচারীকে বিভিন্ন সময়ে এসব কাজে ব্যবহার করেছেন। সাবেক এ দুই ডিনের বিরুদ্ধে শাহবাগ ও রমনা থানায় ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগে জিডিও রয়েছে। তাই দুই কর্মচারীকে রক্ষার্থে এবং অর্থ আত্মসাতের পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দফতরে নানাভাবে তদবির করে চালিয়েছেন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর একে আজাদ চৌধুরী। আদালতে সাক্ষ্য দিলে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও অধ্যাপক আব্দুর রহমানসহ অনেকে ফেঁসে যেতে পারেন। এজন্য তারা অনুষদের বর্তমান ডিনকে বিষয়টি সুরাহা করতে এবং মামলা প্রত্যাহারে চাপ দিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।

এ ছাড়া ছয় মাস কিংবা এক বছর পর পর অডিট করার প্রয়োজন থাকলেও ফার্মেসি অনুষদে বিগত কয়েক বছরেও কোনো অডিট করা হয়নি বিধায় বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। অতএব শিগগিরই অধ্যাপক রহমান ও অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে গ্রেফতার করে ফরেনসিক রিপোর্টসহ তদন্ত করা হলে অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত সব দুর্নীতি বের হয়ে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. এস এম আবদুর রহমান বলেন, এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমরাই আত্মসাতের ব্যাপারে অভিযোগ করলাম, তদন্ত কমিটি গঠন করলাম। সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে বললাম, এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হলো। আমরাই আবার এদের মুক্ত করতে চাইছি- এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও হাস্যকর অভিযোগ।

তিনি আরও বলেন, এ অভিযোগ শুনে আমি রীতিমতো অবাক হচ্ছি। যারা এ ধরনের অভিযোগ দিয়েছে, তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। আমি সিনেট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি এবং আমি ১১ মে নির্বাচনের জন্য নমিনেটেড হয়েছি, আর সেদিনই এ অভিযোগপত্র দুদকে দেওয়া হয়েছে। এতেই বুঝা যাচ্ছে আমার ক্ষতি করতেই এসব প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।

এ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, আমি তো এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

এ বিষয়ে জানতে ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তারা কল রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য, অনুষদটির সদ্য সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. এস এম আবদুর রহমানের সই জালিয়াতি করে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার A/C 0200009379565 এবং A/C 0200000947674 একাউন্ট থেকে আনুমানিক ২০টি চেকের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনুষদের ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে ৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং ফার্মেসি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ছয় মাস কিংবা এক বছর পর পর অডিট করার প্রয়োজন থাকলেও অনুষদে প্রায় দুই বছরেও তা করা হয়নি।

পরবর্তীতে গত ১০ জানুয়ারি ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন তৎকালীন ডিন আবদুর রহমান। কমিটির প্রতিবেদনে দুজনকে সন্দেহ করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি এই ঘটনায় নিয়মিত মামলার সুপারিশ করা হয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটে মামলা করার সিদ্ধান্তটিও অনুমোদিত হয়।

পরবর্তীতে ফার্মাসি অনুষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন ও অফিস সহায়ক মো. সুজনের সংশ্লিষ্টতা পেলে বিভাগ তাদের আটক করে। পরে তাদের আদালত পাঠানো প্রেরণ করা হয়।