সাংবাদিককে বেধড়ক পিটুনির অভিযোগ জাবি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কর্মরত এক সাংবাদিককে বেধড়ক পিটুনি ও লাঞ্ছিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।
রোববার (২০ আগস্ট) দিবাগত রাত ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল মাঠে এ ঘটনা ঘটে। প্রথম দফায় মারধরের পর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে দ্বিতীয় দফায় তাকে পুনরায় মারধর করা হয়।
মারধরের শিকার ওই সাংবাদিক আসিফ আল মামুন। তিনি জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী এবং বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশের (ইউএনবি) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।
এদিকে মারধরের বিচার চেয়ে হল প্রভোস্ট বরাবর অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। এছাড়াও মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর বরাবর অভিযোগপত্রের অনুলিপি জমা দিবেন বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগী আসিফ আল মামুন বলেন, হলের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। হল গেট থেকে কয়েকজন ছেলে হঠাৎ চোর চোর বলে একজনকে ধাওয়া করে। তারা হল-মাঠ পেরিয়ে চায়ের দোকানের দিকে আসতে থাকলে আমি মাঠের দিকে এগিয়ে যাই। এসময় ধাওয়াকারীদের অগ্রভাগে থাকা একজন আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই মাথায় আঘাত করে বসে। এরপর অন্যরাও বেধড়ক মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে আমাকে।
তিনি আরও বলেন, এসময় আমি নিজেকে হলের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর আমিনুর সুমনের নেতৃত্বে আরেক দফা মারধর করেন। এতে আমার চশমা ভেঙে যায় এবং শার্ট ও জুতা ছিঁড়ে যায়। এসময় সাংবাদিক মারতে পেরেছে বলে তারা গর্ব ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
মারধরে মুল অভিযুক্তরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাঈম হোসেন ও আমিনুর রহমান সুমন, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের হৃদয় রায়, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শাফায়েত হোসেন তোহা, শাখা ছাত্রলীগের উপ-পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক ও ৪৭ ব্যাচের চারুকলা বিভাগের মেহেদী হাসানসহ অজ্ঞাত আরও ৫-৭ জন। তারা সবাই শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী এবং সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনের অনুসারী।
হলের সিসিটিভি ফুটেজে চেক করলে দেখা যায়, অজ্ঞাত এক ছাত্র হঠাৎ হলের ভিতরের দিকে দৌড়ে আসলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে ধাওয়া করতে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে আসে। এসময় গেস্টরুম চলাকালীন বাইরে খেয়াল না রাখার জন্য শাখা ছাত্রলীগের উপ-কৃষি বিষয়ক সম্পাদক সারোয়ার শাকিলকে হলের গার্ডদের দিকে তেড়ে আসতে দেখা গেছে।
এছাড়াও হলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে মারধরের সময় শাখা ছাত্রলীগের উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক জাহিদ হাসান, সহ-সম্পাদক রিজওয়ান রাশেদ সোয়ান, ক্রীড়া বিষয়ক উপ-সম্পাদক ফয়জুল ইসলাম নিরব, ৪৭ ব্যাচের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের সৌরভ পাল, পরিসংখ্যান বিভাগের মীর তাওহীদুল ইসলাম, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের আলী আক্কাস, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাহীদ ও সীমান্তকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে জানা যায়, রাত ২টার নাগাদ হলের অতিথি কক্ষে ছাত্রলীগের ৪৭ ব্যাচের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে ৪৮ ও ৪৯ ব্যাচের নেতাকর্মীদের ‘গেস্টরুম’ চলছিল। এসময় বাইরে থেকে কেউ গেস্টরুমের ভিডিও ধারণ করছে সন্দেহে নেতাকর্মীরা একজনকে ধাওয়া করে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ধরতে গেস্টরুমে অবস্থানরতরা ‘চোর চোর’ বলে ধাওয়া করে হলের মধ্যে উৎসুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এমতাবস্তায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী সাংবাদিক হল মাঠে খোঁজ নিতে গেলে গেস্টরুমের ভিডিও ধারণকারী সন্দেহে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে মারধর করে। এসময় ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে উদ্দেশ্য করে ‘আপনি সাংবাদিক, গেস্টরুমের সামনে আপনি কি করেন?’ বলে জেরা করতে থাকে।
এভাবে মারধরকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লেখ করে আসিফ আল মামুন বলেন, হলের ভেতরে একজনকে এভাবে মারধর করতে হলে অন্তত তার পরিচয় জিজ্ঞেস করা হয়। কিন্তু তারা এসেই আমাকে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করে। পরে হলের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক পরিচয় দিলে আরও বেশি মারধর করে। এটা সম্পূর্ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা তাতে সন্দেহ নেই।
মারধরের পর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আসিফের চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানান প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. মো. শামছুর রহমান।
এদিকে মারধরের সংশ্লিষ্টতার বিষয় অস্বীকার করে অভিযুক্ত নাঈম হোসেন বলেন, আমি মারধরে ছিলাম না। মারধর শেষে সেখানে গিয়েছিলাম। তবে সাংবাদিককে উচ্চবাক্যে জেরা ও পরবর্তীতে মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
অপর অভিযুক্ত আমিনুর রহমান সুমন বলেন, আমি ছিলাম না। চোর চোর শুনে আমি দৌড়ে উপরে যাই। পরে নিচে আসার পর জানতে পারি তাকে মারধর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন গণমাধ্যমকে বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি। এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনো মারধরে সমর্থন করে না। উপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিবো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ওয়ার্ডেন ও ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. এজহারুল ইসলাম বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আমরা দেখেছি, একসাথে অনেকগুলো ছাত্র গেস্টরুম থেকে বের হয়ে একজনকে ধাওয়া করেছে। তবে স্পটের কোন ভিডিও নেই। সাংবাদিক আসিফের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এই ঘটনায় আমরা মর্মাহত। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।