ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া সেই দিনটি

  • বৈশাখী মুখার্জী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বৈশাখী মুখার্জী, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়/ছবি: বার্তা২৪.কম

বৈশাখী মুখার্জী, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়/ছবি: বার্তা২৪.কম

আমার মতে, মানুষের মৌলিক চাহিদা হওয়া উচিত সাতটি। সেই সাত নম্বর চাহিদা হলো, মন ভরে ইচ্ছামতো স্বপ্ন দেখার। জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, সময় ও পরিস্থিতির চাপে স্বপ্নের রঙ কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কারণ জীবন জটিলতায় পরিপূর্ণ। তবে আমিও একজন স্বপ্ন বিলাসী, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, তাই জটিলতাগুলোর মাঝেও স্বপ্ন বুনতে থামি নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন আমার জন্য রূপকথার মতো ছিল। বাস্তবে তা পূরণ হবে কখনো ভাবিনি। কোনো এক শুভক্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামক নন্দন কাননে বিচরণ শুরু করে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে এখন আমার বিদায়ও সন্নিকটে।

বিজ্ঞাপন

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার জীবনের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যায়। তাই সোনালি সময়ের শেষ দিনগুলি পার করার সময় আজ অতিশয় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি । আজও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার দিনটি আমার কাছে স্বপ্নময়। তাই স্বর্গপতনের আগে নিজের গল্প লেখার এই অনন্য সুযোগ ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। আবার কান টানলে মাথা আসার মতো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে বলতে হলে কলেজের শেষ দিনগুলো থেকে শুরু করতেই হবে। তাই অনিবার্যভাবে সেই প্রসঙ্গ এসেই যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম কলেজে থাকাকালীন সময়ে। এইচএসসিতে মানবিক বিষয়ে মাইগ্রেট করার পর আমারও স্বপ্নচূড়া ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এক রাশ শঙ্কা, ভয় ও আকাশ ছোঁয়ার আশা নিয়ে ভর্তিপরীক্ষা পূর্ববর্তী প্রস্তুতির সময়ের নোটখাতাগুলোতে লিখে রাখতাম ‘আমার পদচারণায় মুখরিত হোক ঢাবি ক্যাম্পাস।’

বিজ্ঞাপন

‘এত আত্মবিশ্বাস! তোর তো ঢাবি সিট নিশ্চিত’- এরকম মন্তব্য পেতাম সহপাঠীদের থেকে। অবশ্য কোচিং শিক্ষক আমাদেরকে উৎসাহিত করতে বলতেন- তোমার পদচারণায় মুখরিত হোক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। যেখানে স্বপ্নবিভোর আমি ক্যাম্পাসের স্থলে ঢাবি নামটি যোগ করেছিলাম। প্রস্তুতিকালীন সময়ে নিয়মিত দিকনির্দেশনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গল্প ও অনন্য সুন্দর ক্যাম্পাসের স্থিরচিত্র পেতাম শ্রদ্ধেয় ফারুক আহমেদ ভাইয়ের থেকে। তাই তার কাছেও আমি চিরকৃতজ্ঞ।

অতিশয় আত্মবিশ্বাসী ছিলাম কিনা জানিনা, তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম আমি তুলিনি, ভর্তিও হইনি। মনে হয়েছিল, এতে আমার মনোবল ঝাঁকুনি খাবে, সঙ্গে আরো চারটে টাকাপয়সা খরচ হবে। ভর্তিপ্রস্তুতির সময়কালীন মোটা অঙ্কের খরচের কথা বোধকরি অনেকেরই জানা। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না হলে গোটা একটা বছর ভবঘুরে হয়ে থাকব, এই ভয়টা একেবারে ছিল না তা অস্বীকার করা যাবে না।

এদিকে, আমার চারপাশের অনেকে; এমনকি আমার প্রিয় বন্ধুও এই ঝুঁকি নেয়নি। তাই সংশয় কিছু ছিল ভিতরে, তবে সেটাকে এতটা ঘনীভূত হতে দিইনি কখনো। স্মার্টফোনটা নিজের কাছেই রেখেছিলাম তবে তা যেন আমার স্বপ্নের পথে বাধা না হয় এজন্য তালাবন্ধ করে ট্রাঙ্কে রেখে দিতাম। হাজার হোক মোবাইল ফোন যে টাইম কিলিংয়ে ওস্তাদ এ সত্য সবার জানা।

আমি সর্বমোট তিনটি ভর্তিপরীক্ষা দিয়েছিলাম। ঢাবির ‘খ’, ‘ঘ’ ও জাবির ‘খ’। সৌভাগ্যক্রমে তিনটিতেই মেধাক্রম পাই। এর মধ্যে ঢাবির ‘খ’ ইউনিটে ভর্তিপরীক্ষা ছিল আমার প্রথম কোনো ভর্তিপরীক্ষা। এ সিদ্বান্তের জন্য আজও আমি আফসোস করি। স্বভাবতই অর্থ সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য জবির ফর্ম আমি তুলিনি।

ঢাবির আগে জবির পরীক্ষা ছিল। আমার যেসব বন্ধুরা জবিতে পরীক্ষা দিয়েছিল। প্রায় সবাই ঢাবির ‘খ’ ইউনিটে ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ঢাবির ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষা আমার খুব বেশি ভালো হয়নি। অসুস্থতা ও সময় ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির জন্য কিছু মার্কস ছেড়ে আসি।আমার চান্স পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আমাদের সময় অর্থাৎ ২০১৯-২০ সেশন থেকেই ঢাবি প্রথম লিখিত পরীক্ষাতে যায়। তাই ফলাফল প্রকাশে একমাস সময় লেগেছিল। ততদিনে জাবির ফলাফল আসে। আমি চান্স পাই।

আমার কোচিংয়ের শিক্ষক ও বন্ধুরা অভিনন্দন জানায়। খুশি ছিলাম, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রার্থনাও করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল প্রকাশের দিন মা’য়ের মন্দিরে গিয়ে বসেছিলাম। অবশেষে ঈশ্বরের কৃপা, বাবা-মায়ের আশীর্বাদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দোয়ায় একটা জায়গা পেয়েই যাই। মানুষ স্বপ্নকে ছুঁতে পারলে সম্ভবত তার শব্দের বেগটা হারিয়ে যায়। আমার অবস্থাও সেদিন এমনই হয়েছিল।

সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ও ওনাদের অবদানে আমার সেই সৌভাগ্য হলো নিজেকে স্বপ্নের জায়গায় দেখার। তখন থেকেই নতুন কিছু রঙিন স্বপ্ন, আবেগ, উদ্দীপনা আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়েই ২০২০ এর ১ জানুয়ারি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম পা রাখা।

ঝিনাইদহ থেকে চার জেলা পাড়ি দিয়ে আসি এই নতুন শহরে। নতুন মানুষদের ভিড়ে, জীবনের নতুন স্বপ্ন বুনতে। যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করলাম, স্বপ্নের রং আবার তার খোলস পাল্টাল। আমার স্বপ্নের তরী নোঙর করেছে নতুন ভুবনে। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই জ্ঞানের সমাহার। উন্মুক্ত ক্যাম্পাস, বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বন্ধু, আড্ডা, বড় ভাইয়া-আপুদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর বিস্তৃত পরিসরে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরা। এই অনুভূতিগুলো আসলে বিরল।

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে আমার ক্ষেত্রেও অনুভূতিগুলো একই রকমের। প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় লালবাস, বন্ধু, আড্ডা এবং নিজেকে মেলে ধরার মধ্যে আমি আমার জীবনের তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছিলাম সেদিন। সময়ের টানে আজ আমার বিদায়বেলায়ও উপস্থিত।

আমি ভালো করেই জানি এরপর যত সুবিধাজনক জায়গায়ই যাই না কেন বাংলাদেশের হৃদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নিজের করে জীবনযাপন করতে পারব না। এক টাকার লাল চা আর তিন টাকা সিঙ্গারা খেতে খেতে বন্ধুত্বের গল্পগুলো জমে ওঠে শিক্ষার্থীদের। কারো মুখ ভার করে থাকার যেন এখানে অধিকার নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা ইঞ্চি হয়ে ওঠে ভীষণ প্রাণবন্ত, প্রতিটা মুহূর্তই জমে ওঠে জীবনের গল্পে; গল্পে গল্পে রচিত হয় যাপিত জীবনের এক অনন্য কথামালা।

এরই সঙ্গে ক্যারিয়ারের প্রথম নিয়ামক হচ্ছে আন্ডারগ্র্যাড-এর বছরগুলো। এই বছরগুলোতে ঠিক হয় একটা বাচ্চা কতোটা ‘এক্সপোজার’ পাবে, কতোটা স্কলার হয়ে নিজেকে গড়তে পারবে? ক্যারিয়ারে এগোনোর জন্য প্রাসঙ্গিক পুষ্টিগুলো তার মন ও মস্তিষ্ক পাবে কতোটা এই বছরগুলোতেই নির্ধারণ হয়! এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন কিছু বিশেষ শিক্ষকের সাহচর্য। আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি,তাদের আমি পেয়েছি।

ঠিক যেমনভাবে কথা বলার শিক্ষা, বর্ণশিক্ষা, নীতি ও আদর্শের শিক্ষা এসব আসে পরিবার থেকে। তেমনভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা অর্জন করি বিবেকবোধ, বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা, পরিচিতি, আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার শক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে এখন পর্যন্ত যা দিয়েছে তা যদি জীবনের পরবর্তী ধাপগুলোতে ব্যবহার করতে পারি তবেই আমি মনে করি এই ঋণ ও গুরুদক্ষিণা শোধের ইচ্ছাটা পূরণ হবে। প্রাকৃতিক নিয়মের মত স্নাতক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইলফলক সমাবর্তন সজ্জার দিকে আমার যে ওডিসি চলছে তাকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও আমি চলতে দিতে বাধ্য।

এখন আমার খুব করে ইচ্ছে, বাবা-মাকে একসঙ্গে আমার সমাবর্তনে এনে নিজের অর্জনকে তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। যেই গর্বের ও তৃপ্তির হাসি আমার ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন তাদের মুখে আমি দেখেছিলাম, সে হাসি বার বার ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সামর্থ্য চাই সৃষ্টিকর্তার কাছে। আমার বাবা কখনো তার জীবনে ঢাকায় আসেননি, আমার ক্যাম্পাসও দেখেননি। এজন্য মধুরতম সেদিনটির প্রতীক্ষায় আজকের বুক ভরা দুঃখকে বেদনা-হাস্যে বরণ করছি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়