দুই দশকে পদার্পণ করল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • জবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের জগা বাবুর পাঠশালা যে একদিন দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হবে, তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। রাজধানী ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীকৃতি পায় দেশের অন্যতম প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠটি। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সাফল্যের ১৯ বছর পূর্ণ করে ২০ বছরে পদার্পণ করছে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পার করল দেড়শ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ২০ অক্টোবরকে 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস' হিসেবে পালন করে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

মহান জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। পূর্বতন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। অধ্যাপক ডক্টর এ কে এম সিরাজুল ইসলাম খান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে সাড়ে সাত একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও কেরানীগঞ্জ জেলখানার বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব ৭.৫ একর কেনা জমি হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য রয়েছে ২০০ একর জমি। যার ১৮৮.৬০ অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে । বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি অনুষদে ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। মাত্র ৭ একর জায়গায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও এর অগ্রযাত্রার বাস্তবায়ন কষ্টসাধ্য। সে বিবেচনায় কেরাণীগঞ্জের তেঘরিয়ায় প্রায় ২০০ একর জমির উপর নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন অত্যাধুনিক দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনায় নির্মিতব্য এ ক্যাম্পাস হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক ও নান্দনিক ক্যাম্পাস । এছাড়াও গবেষণা কার্যক্রমে পারস্পরিক সহযোগিতা লাভের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা শিল্প পরিষদ, পরমাণু শক্তি কমিশন, ঢাবি, বুয়েট, বাকৃবি, ইবিসহ বেশ কয়েকটি বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জবি সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আবাসন ও যানবাহন সমস্যায় জর্জরিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোবল, সাহস ও পরিশ্রমী মানসিকতা অবাক করে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। ব্যয়বহুল ঢাকা শহরের মেস-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিন পার করা সত্ত্বেও তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সর্বদা মাতিয়ে রাখে। শুধু আন্দোলন আর সংগ্রামেই থেমে নেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেরই বলিষ্ঠ উপস্থিতি এই আন্দোলনে গতিসঞ্চার করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগের শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ এই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন। স্বৈরাচারের দোসর ও পুলিশের আক্রমণে আহত হয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষাশহিদ রফিকউদ্দিন আহমদ, মৈয়মনসিংহ গীতিকার সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেন, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, ভাষা আন্দোলনের নেতা শওকত আলী, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি ও ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদ, ঔপন্যাসিক শওকত আলী, ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, সাংবাদিক রাহাত খান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক, সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী,ভাষা শহীদ রফিল,  ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ প্রমুখ সেই কৃতীজনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬০৫ জন নিয়মিত শিক্ষার্থীকে মেধাবৃত্তি এবং ১ হাজার ১৫৬ জনকে অবৈতনিক বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। দুই ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকার শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিএনসিসি, রোভার স্কাউটস, রেঞ্জার ইউনিট থেকে মোট ২৫০ জন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও গবেষকদের সুবিধার্থে বছরে দুই বার এমফিল, পিএইচডি ভর্তি করা হচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একাডেমিক মাস্টারপস্ন্যান তৈরির পরিকল্পনা চলছে। এছাড়াও বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ট্রান্সক্রিপট ও গ্রেড শিট ভেরিফিকেশনের উদ্যোগ, ই-নথি চালু, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ষোড়শ বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১১ শিক্ষার্থী মনোনীত হয়েছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের 'জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ' পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ শিক্ষার্থী। স্নাতকের সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় অনুষদের ছয় শিক্ষার্থী। এটিএন বাংলা ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি কর্তৃক আয়োজিত ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে 'ফাস্টেস্ট টাইম টু সেটআপ অ্যান্ড টফেল ফাইভ ইরেজার' টাইটেলে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে পাঁচটি রাবার দাঁড় করিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম অংকন। ইউটিউব থেকে শিখে একাই অ্যানিমেশন ছবি বানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিসান ইসলাম অনন্ত। এছাড়াও ২০১৯ এসএ গেমস এ বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ী মারজান আকতার প্রিয়া এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেবাখাতের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন। ৫৬টি যানবাহন পরিবহন পুলে বিদ্যমান রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পর ২০২০-এ প্রথম সমাবর্তন হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুরান ঢাকার ধূপখোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজিত হয় এই সমাবর্তন। সমাবর্তনে অংশ নেন প্রায় ১৮ হাজার গ্র্যাজুয়েট ও অন্য ডিগ্রিধারী।

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিক চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলছে দৃপ্ত শপথে। গৌরবের বিষয় হলো Time Higher Education-এর World University Ranking 2025 এ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৫০১তম অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে। উচ্চশিক্ষার ঐতিহ্য ও উন্মেষে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ উনিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।