ফ্রেশার সিভি'র এ টু জেড

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফ্রেশার সিভি'র এ টু জেড

ফ্রেশার সিভি'র এ টু জেড

যেকোন চাকরিতে আবেদনের জন্য সিভি প্রয়োজন। সিভি কেমন হওয়া চাই, কি কি তথ্য থাকবে, ফরম্যাট কেমন হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদন্দ্বে ভুগেন অনেকেই। বিশেষত ফ্রেশারদের প্রথমবারের মতো সিভি তৈরির সময় নানা প্রশ্ন থাকে।

ফ্রেশারদের সিভি তৈরির নানাদিক নিয়ে বার্তা২৪.কম ক্যারিয়ার পেইজ এডিটর রায়হান আহমদ আশরাফীর সঙ্গে কথা বলেছেন আরএসপিএল গ্রুপের এইচআর ম্যানেজার এবং বাংলাদেশ এফএমসিজি এইচআর সোসাইটির জয়েন্ট সেক্রেটারি কাইয়ুম ইসলাম সোহেল।

বিজ্ঞাপন

বার্তা২৪: সিভি তৈরির ক্ষেত্রে কি কি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: চাকরির আবেদনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন সিভি। সিভি মূল্যায়নের মাধ্যমে চাকরিদাতারা চাকরিপ্রার্থী সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকেন। বলা যায়, চাকরির আবেদনে সিভি চাকরিপ্রার্থীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে কাজ করে। তাই সিভি এমন হওয়া উচিত যেন সহজেই চাকরিপ্রার্থী সম্পর্কে দরকারি তথ্যগুলো পাওয়া যায়। আপনার সিভি হতে হবে এমন যা সহজে পাঠযোগ্য, সবসময় যিনি এই সিভিটা দেখবেন এবং পড়বেন তার কথা চিন্তা করে আপনাকে আপনার সিভি বানাবার চেষ্টা করতে হবে, যার জন্য যেখানে আবেদন করছেন এবং যে পদে আবেদন করছেন তাকে ভালো করে পর্যালোচনা করা জরুরি।

বিজ্ঞাপন

বার্তা২৪: সিভি ফরম্যাট কেমন হবে?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: প্রথম সিভি তৈরির সময় অনেকেই বিভিন্ন ফরম্যাট খুঁজেন। কেউ আবার সিনিয়র বা পরিচিত কারো সিভি সংগ্রহ করে সেখানে নিজের তথ্য বসিয়ে সিভি তৈরি করে ফেলেন। ফলে অন্যের বাবা-মা নিজের বাবা-মা কিংবা অন্যের মোবাইল নাম্বার নিজের নাম্বার হয়ে যাবার সুঝোগ থেকেই যায়। ভালো কারো সিভি অনুসরণ করে নিজের সিভি নিজে মনের মত করে তৈরি করা হচ্ছে সঠিক ফরম্যাট, কাট কপি পেস্ট করে সিভি তৈরি কোনোভাবে কাম্য নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্রেশারদের সিভি দুই পেইজের মধ্যেই হওয়া উত্তম। সিভি ইনফোগ্রাফিক বা নরমাল যেকোন ফরম্যাটে হতে পারে তবে বাংলাদেশ শর্ট ইনফোগ্রাফিকের জন্য এখনো পুরোপুরি তৈরী নয়। নরমাল ফরম্যাটে অফিসিয়াল ফন্ট (যেমন: calibri, Times New Roman) ব্যবহার করা যেতে পারে। ফন্ট সাইজ ১১/১২ এবং স্পেস ১ বা ১.২৫ হতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন তা সহজে পাঠযোগ্য হয়। ফন্ট কালার একের অধিক ব্যবহার করা যেতে পারে তবে একেক পার্টে একেক রংয়ের ফন্ট হলে দৃষ্টিকটু হবে। যাই ব্যবহার করি না কেন তার ধারাবাহিকতা যেন থাকে সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে।

সিভি তৈরিতে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, সিম্পল ইজ দ্য বেস্ট। সব মিলিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন সিভি চাকরিপ্রার্থী সম্পর্কে রিক্রুটারদের মনে ভালো ধারণা তৈরি করে, কারন আপনার অতিরঞ্জিত কথা এবং রঙ রিক্রুটারের চোখে বেমানান হলে সিভিটা তার মনে আপনাকে দেখার আগেই একটা নেগেটিভ ধারাণা তৈরী করে দিতে পারে। ভুলে যাবেন না আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী।

বার্তা২৪: ফ্রেশারদের সিভিতে কি কি তথ্য থাকতে হবে?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: সিভির শুরুতে নাম, ঠিকানা, ইমেইল এড্রেস, লিংকডইন এড্রেস (যদি লিংকডইন আপডেটেড না হয় তা হলে না দেয়াই ভালো) এবং ব্যবহৃত ফোন নম্বর থাকবে, নম্বরের বেলার একের অধিক তবে দুই এর বেশি না দেয়াই ভালো। ফ্রেশারদের ক্ষেত্রে এরপরের অংশে ক্যারিয়ার অবজেকটিভ থাকবে, অবশ্যই কপি পেস্ট নয়। তারপর শিক্ষাগত যোগ্যতা, ইন্টার্ণশিপ, অ্যাওয়ার্ডস, এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিজ, ট্রেনিং, স্কিলস, শখ, পারসোনাল ইনফরমেশন, রেফারেন্স এবং শেষে ডিক্লারেশন থাকতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ আপনার ক্যারিয়ার প্লান অনুসারে হবে, শিক্ষাগত যোগ্যতা এর সাথে কোন এচিভমেন্ট থাকলে তাকেও উল্লেখ করে দিন। এভাবে যেখানেই নিজের সেরা অর্জন কিছু আছে তাকে উল্লেখ করে দিন। ভুলে যাবেননা আপনাকে মুল্যায়ন করা হবে আপনার সিভিতে দেওয়া তথ্যকে দেখে এবং তারপর আপনাকে ডেকে নেওয়া হবে পরবর্তী ধাপগুলোর জন্য।

বার্তা২৪: ক্যারিয়ার অবজেকটিভ লেখার নিয়ম সম্পর্কে জানতে চাই।

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: যাদের চাকরির অভিজ্ঞতা রয়েছে সেটা যেই লেভেলেই হোক না কেন লিখুন। তবে মনে রাখবেন আজ এখানে তো কাল ওখানে এমন অভিজ্ঞতার কথা না লিখাই ভালো। যারা নিজেরা নিজেদের ডিরেক্টর বা সিইও হিসেবে ঘোষনা দিয়ে কোম্পানি খুলে চাকরিও খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা এত বড় পজিশন না লিখে নিজের ব্যবসার বা স্টার্ট আপ এর জন্য চেষ্টা করেছিলেন সেটাকে লিখুন। ফ্রেশারদের যেহেতু চাকরির অভিজ্ঞতা থাকে না, তাই ক্যারিয়ার অবজেকটিভ এমনভাবে লিখতে হবে যেন তার ক্যারিয়ারে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। অনেকে ইন্টারনেট থেকে কপি পেস্ট করে ক্যারিয়ার অবজেকটিভ সিভিতে তুলে দেয়। আবার অনেকে একই অবজেকটিভ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের পদে আবেদন করেন। সব পদে আবেদনের জন্য একই ধরনের ক্যারিয়ার অবজেকটিভ থাকা কোনোভাবে কাম্য নয়। প্রথমে ইংরেজিতে ক্যারিয়ার অবজেকটিভ তৈরিতে অসুবিধা হলে আলাদাভাবে বাংলায় তৈরি করা যেতে পারে এবং তা ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে সিভিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।

বার্তা২৪: সিভিতে ছবি কিভাবে দেয়া উচিত?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: সিভিতে পাসপোর্ট সাইজের ছবি সংযুক্ত করতে হবে। সিভির উপরের অংশে ছবি সংযুক্ত করতে পারেন। ছবি অবশ্যই প্রফেশনাল হতে হবে। সেলফি বা আনপ্রফেশনাল ছবি সিভিতে দেয়া উচিত নয়। চেষ্টা করুন ভালো কোন প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে রিসেন্ট ছবি দিতে, এমন যেনো না হয় আপনার ছবিতে ক্লিন শেভ কিন্তু আপনি অনেক বড় করে দাড়ি রাখাতে চেনা যাচ্ছেনা, কিংবা ছবিতে দাড়ি আছে অথচ বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই। ছবি তোলার সময় ফরমাল স্যুট এবং টাই পড়ে তুলতে পারেন এতে দেখতে ভালো দেখাবে। তবে মাথা কেটে অন্যের স্যুটের ভিতরে দিতে গিয়ে যেনো আপনাকে হাসির পাত্র না করে দেয় সেদিকেও লক্ষ রাখবেন।

বার্তা২৪: স্যোশাল মিডিয়া প্রোফাইল লিংক সিভিতে দেয়া যাবে কী?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: সিভিতে লিংকডইন প্রোফাইল লিংক দিয়ে দেয়া ভালো। তবে এক্ষেত্রে লিংকডইন প্রোফাইল অবশ্যই গোছানো থাকতে হবে। সিভিতে যা ইনফরমেশন থাকে সেগুলো দিয়েই একটু সময় নিয়ে চেষ্টা করলে সুন্দরভাবে নিজের লিংকডইন প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব। প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক হওয়ায় কর্পোরেট জগতের অধিকাংশই লিংকডইন নিয়মিত ব্যবহার করেন বলে কেবল সিভিতে দেওয়ার জন্য নয় নিজের চেনা জানার পরিধি বাড়াতেও লিংকডইন ব্যাবহার করুন। লিংকডইন প্রোফাইল গোছালো না হলে সিভিতে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এছাড়া অন্যান্য সোশাল মিডিয়া প্রোফাইল লিংক জব ন্যাচার দেখে শেয়ার করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, চাকরিদাতা আপনার সম্পর্কে ধারণা নিতে নিয়োগের আগে আপনার স্যোশাল মিডিয়া প্রোফাইল বা একটিভিটি খুঁজে দেখতে পারেন, সুতরাং ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টের ব্যাপারে সবসময় প্রফেশনাল হবেন এটাই একমাত্র সাজেশন। মনে রাখবেন প্রোফাইল লিংক দেন বা না দেন রিক্রুটার আপনার প্রোফাইল খুজে দেখতে পারেন ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করার জন্য, সুতরাং আপনার ডিজিটাল প্রোফাইল এর ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করুন, যা ইচ্ছে লিখা বা শেয়ার থেকে বিরত থাকা বুদ্ধিমানের কাজ।

বার্তা২৪: কি ধরনের হবি (শখ) সিভিতে দেয়া উচিত?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: আপনি যা করতে পছন্দ করেন এবং যেসব শখের কাজ আপনি করেন, তা সিভিতে উল্লেখ করতে পারেন। তবে শখ যাই দেননা কেন তাকে মিন করে দিবেন। অনেকে হবি হিসেবে লিখেন ট্রাভেলিং, সেক্ষেত্রে শেষ কবে এবং কোথায় ভ্রমণ করেছেন, তা ইন্টারভিউতে জানতে চাইতে পারে, সুতরাং সকল প্রিপারেশন যেন নিয়ে যাওয়া হয় এই ব্যাপারে। অনেকে আবার বুক রিডিং উল্লেখ করেন, সেক্ষেত্রে সর্বশেষ কোন বইটি পড়েছেন, কি শিখেছেন সেখান থেকে, কার কার বই ভালো লাগে, কয়েকটি বইয়ের নাম সম্পর্কে ইন্টারভিউতে জানতে চাওয়া হতে পারে যার জন্য প্রস্তুত থাকাটাই কাম্য। তাই আপনি যাই করেন না কেনো, সিভির দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্য এমন কোনো হবি (শখ) উল্লেখ করা উচিত নয় যার সম্পর্কে আপনার ধারণা কম বা জানেন না।

বার্তা২৪: সিভিতে রেফারেন্স কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: সিভিতে রেফারেন্স দেয়া উত্তম। এবং অবশ্যই চেষ্টা করবেন দুইজনের রেফারেন্স দিতে। এর মধ্যে একজন আপনার শিক্ষক/ ট্রেইনার এবং একজন পরিচিত প্রফেশনাল কোনো ব্যক্তি হতে পারে। যাদের নাম দেয়া হবে তাদের অবশ্যই অনুমতি সাপেক্ষে রেফারেন্সে যুক্ত করতে হবে। সিভির এক কপি তাদের সাথে শেয়ার করে রাখা উচিত, যাতে করে আপনার রেফারেন্স চেক করতে গিয়ে এমন যেন না হয় আপনার নাম তিনি মনে করতেই পারছেন না বা আপনার সম্পর্কে ভালো কিছু বলতে পারছেন না। আর যখনি আপনার সিভি হালনাগাদ করবেন তার কপি সাথে সাথে যাদের রেফারেন্স দিয়েছেন তাদের কাছে পাঠিয়ে রাখবেন এবং তাদের নতুন তথ্যগুলিও জানাতে ভুলবেন না।

বার্তা২৪: সিভিতে সিগনেচার ব্যবহারের নিয়ম?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: সিভির একদম শেষাংশে সিগনেচার দেয়া হয়। যদি আপনি সিভির শেষে ডিক্লারেশন ব্যবহার করেন, অর্থাৎ উপরে দেয়া আমার সব তথ্য সঠিক বা এধরনের কথা লিখে থাকেন তাহলে অবশ্যই এরপর সাক্ষর দিয়ে দিবেন। হার্ডকপিতে সরাসরি সাক্ষর এবং সফটকপিতে ডিজিটাল সিগনেচার (স্ক্যান) দিতে পারেন।

বার্তা২৪: সবমিলিয়ে সিভি তৈরিতে যেসব বিষয় মাথায় রাখা উচিত?

কাইয়ুম ইসলাম সোহেল: অনেকেই সিভি কাট-পেস্ট করেন। এতে যার সিভি কপি করা হয়, তার কিছু ইনফরমেশন ভুলবশত থেকে যায়। তাই সিভি পুরোপুরি তৈরির পর সব তথ্য ভালোভাবে দেখে নেয়া উচিত। সিভিতে এমন ফোন নম্বর দেয়া উচিত যা সবসময় সাথে থাকে, বন্ধ বা অব্যবহৃত নম্বর দেয়া ঠিক নয়। ইমেইল এড্রেস অবশ্যই প্রফেশনাল হতে হবে, দৃষ্টিকটু বা আজেবাজে ইমেইল এড্রেস পরিহার করতে হবে। সিভিতে বানান ভুল থাকা কোনোভাবে কাম্য নয়। আরেকটা কথা ভুলকরেও কিন্তু না বুঝে বা বুঝে ভুল তথ্য দেওয়া যাবেনা। একের অধিক ফ্রন্ট টাইপ বা দৃষ্টি কটু রঙ ব্যাবহার করা যাবেনা। ফ্রন্ট সাইজ অবশ্যই যেন ১১/১২ এর বেশি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। স্যালারি এক্সপেক্টেশান সিভিতে ফ্রেশারদের জন্য না দেয়াই উত্তম।

সবমিলিয়ে সিভি এমন হতে হবে যেন তা চাকরিদাতার কাছে আপনার সম্পর্কে একটি সুন্দর ধারণা উপস্থাপন করে। একটি স্মার্ট সিভি একজন চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি পাওয়ার বা ইন্টারভিউতে কল পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে রাখে। সুতরাং এমন সিভি আপনাকে বানাতে হবে যা প্রথম দেখাতেই রিক্রুটারকে বাধ্য করে আপনাকে ডেকে নিতে, কারন একজন রিক্রুটার যদি তার প্রথম ৫ সেকেন্ডের মাঝে আপনার সিভির প্রতি আগ্রহী না হয় তাহলে আপনার জন্য সু-সংবাদ নাও আসতে পারে।

সব শেষে এটা বলতেই হয়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই কিংবা ভড়কে গিয়ে এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করার কিছু নেই। কিংবা এখনি প্রফেশনাল সিভি রাইটারের কাছে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করার দরকার নেই। নিজের স্বপ্নের চাকরি নিজের হাতের বানানো সিভি দিয়েই হোক এটাই কামনা করছি।

ক্যারিয়ার বিষয়ক যেকোন পরামর্শের জন্য ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়।