জীবনের মূল্যে কেন উপাচার্য-রক্ষা
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের জীবনের চাইতেও উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ‘চেয়ারের মূল্য’ বেশি বলেই মনে হচ্ছে। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে টানা ছয়দিনের অনশন, তেরোদিনের আন্দোলনেও সরকারের টনক নড়েনি। জীবনের মূল্য গুরুত্ব পায়নি সরকারের কাছে, উপাচার্যের কাছে, শিক্ষক সংগঠনগুলোর কাছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ, সুধীজন, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীসহ অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
যারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জীবনকে মূল্যবান ভাবছেন, তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে বলছেন তারা ব্যাপকভাবে প্রভাববিস্তারী জনগোষ্ঠী নয়। তাই হয়ত তারা উপাচার্যের চেয়ারের চাইতে অনশনরত শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের এই গুরুত্ব দেওয়া যদিও উপাচার্যের সিদ্ধান্তে, সরকারের সিদ্ধান্তে কোন প্রভাব ফেলছে তবু বলি এটা অন্তত মানবিকতার বিপুল পরাজয়ের বিপরীতে ক্ষীণতম হলেও আশার আলো।
হয় উপাচার্যের পদত্যাগ, নয় মৃত্যু— এমনই সংকল্প শাবির অনশনরত শিক্ষার্থীদের। দীর্ঘ এই আন্দোলন, তবু নির্বিকার উপাচার্য, নির্বিকার সরকার, নির্বিকার শিক্ষক সমাজ, নির্বিকার আচার্যসহ সবাই। এমন অবস্থায় তারা মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ ও মুমূর্ষু অবস্থায় তারা হাসপাতালে যাচ্ছে, সেখানেও খাবার গ্রহণ করছে না। ওখান থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে অনশনস্থলে। বিদ্রোহ তাদের রক্তে মিশে গেছে। আপোষ তাদের কাছ থেকে দূরে অনেক দূরে চলে গেছে।
তাদেরকে ফেরানোর মত কোন অভিভাবক নেই শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে, সিলেটে, এমনকি রাষ্ট্রেও। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নিজ থেকে পদত্যাগ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। সরকার বললে পদত্যাগ করবেন, অন্যথায় নয়। এদিকে, সরকারের যে অবস্থান তাতে এটাও পরিষ্কার সরকার চাইতে না ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত’ এই উপাচার্যের পদত্যাগ। শিক্ষার্থীদের প্রাণ গেলে যাক, তবু উপাচার্য রক্ষা পাক—এমনই ভাবনা সরকারের।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত শুক্রবার লোক দেখানো যে ভূমিকা পালন করেছেন সেটা অপ্রত্যাশিত। আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে তার সঙ্গে আলোচনার যে প্রস্তাব প্রথমে তিনি দিয়েছিলেন সেটা আমাদেরকে বিস্মিত করেছিল। শিক্ষার্থীরা অবশ্য যোগ্য প্রত্যুত্তরে তাকে সিলেটে এসে তাদেরকে দেখে যাওয়া, অথবা ভিডিয়ো কনফারেন্সে যে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল সেটা পরিপক্ব চিন্তার প্রকাশ ছিল। শেষ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী সিলেট আসেননি, শিক্ষা উপমন্ত্রীও সিলেট আসেননি, ঢাকা থেকে সরকারের কেউ সিলেটে এসে শিক্ষার্থীদের দেখে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। তবে পরের দিন মাঝরাতে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙার আহবান জানান। শিক্ষার্থীরা ওই সময়ে তাদের দাবির কথা জানালেও তিনি উপাচার্যের পদত্যাগ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি।
মন্ত্রী-শিক্ষার্থীদের আলোচনা ওই পর্যায়েই শেষ! এরপর শনিবার মন্ত্রী কথা বলবেন বললেও কথা বলেননি। রোববার গেছে, সোমবার গেছে; মন্ত্রীর তরফে যোগাযোগ হয়নি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের যে সকল নেতা শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের নামে শাবিতে গিয়েছিলেন তারাও যাননি। উপরন্তু এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে শিক্ষামন্ত্রী-শিক্ষা উপমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের নিয়ে যে সকল ইঙ্গিত দিয়েছেন সেগুলো আর যাই হোক সুচিন্তার প্রকাশ বলে মনে হয়নি। শিক্ষার্থীদের নিষ্পাপ-নির্ভেজাল-রাজনৈতিক অভিসন্ধিহীন আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। আগামী দুই বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন এই প্রসঙ্গ এনে তারা শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে গেছেন, যাচ্ছেন। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, একই সঙ্গে অমানবিকও।
একদিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অহিংস আন্দোলনের সর্বশেষ ধাপ আমরণ অনশনে। একের পর মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে যাচ্ছে, ফিরছে, স্যালাইন গায়ে নিয়ে বেঁচে আছে; অন্যদিকে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাষায় কালিমা লেপনের অপচেষ্টা; তাও আবার মন্ত্রীর পক্ষ থেকে। শিক্ষার্থীদের জীবনের চাইতে মূল্য বেশি রাজনীতির? অথচ এই শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনকে সচেতনভাবে রাজনীতির বাইরে প্রথম থেকেই রেখেছে।
আন্দোলনের স্লোগানে শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়া হয়। কিন্তু শাবির এই আন্দোলনে অদ্যাবধি সরকারের বিরুদ্ধে কোন স্লোগান উচ্চারিত হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী টেলিভিশনে-টেলিভিশনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলছেন যদিও তবু তারা এর পাল্টা জবাব দিচ্ছে না। আলোচনা প্রসঙ্গে মন্ত্রী কথা দিয়ে কথা রাখেননি, আন্দোলনে ‘তৃতীয় পক্ষ’ দেখছেন যদিও, শিক্ষার্থীরা তবু সতর্ক। মন্ত্রী ‘অভিভাবক’ বলছেন নিজেকে, ‘মা’ প্রতিরূপ দাবিও করছেন, তবে তার অবস্থান দাবির সঙ্গে মেলে না, বলা যায় বিপরীত। মন্ত্রীর অবস্থান স্পষ্টত উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পক্ষে।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের গণভিত্তি আছে, জনসমর্থন আছে। শিক্ষার্থীদের পাশে তাদের পরিবার আছে, পুরো দেশ আছে। নেই শুধু শাসক। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীনভাবে পেটানো, সাউন্ড গ্রেনেড, মামলা দেওয়া এই উপাচার্যকে কেন রক্ষা করতে চায় সরকার? উপাচার্যের ব্যর্থতার ভার কেন নিতে যাচ্ছে তারা? তার পদত্যাগকে কেন সরকারের পরাজয় হিসেবে দেখছে তারা? দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ, এজন্যেই কি? এই কালক্ষেপণ, কূটকৌশল অথবা জোর করে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে টিকিয়ে রাখলে কি বিজয়ী হবে সরকার? ফরিদ উদ্দিনের টিকে যাওয়ার সঙ্গে তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার কী সম্পর্ক? কেন শিক্ষার্থীদের জীবনের চাইতে মূল্যবান হয়ে ওঠবেন একজন উপাচার্য, একজন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ?
সরকারি প্রভাবে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ টিকে আছেন। এই পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারানো ‘না-মানুষ’ রূপে কি তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেননি? সরকার তাকে টিকিয়ে রেখেছে, অন্যের ব্যর্থতা নিজেদের ঘাড়ে নেওয়ার আত্মবিনাশী ধারাবাহিকতা অবলম্বনে। দিন শেষে এতে উপাচার্যের যেমন লাভ নেই, তেমনি লাভ নেই সরকারেরও। এরমাঝে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে যে সকল শিক্ষার্থীর সেগুলো অপূরণীয়।
দুঃখিত শাবিপ্রবি, চাইলেও কিছু করতে পারি না আমরা। ক্ষমা করো! আমরা শাসক নই, মানুষ এখনও; জীবনকে মূল্য দেওয়া একদল সংবেদনশীল।
কবির য়াহমদ: লেখক ও সাংবাদিক, ইমেইল: [email protected]