বারো মাসে তের পার্বণ
‘এসো হে বৈশাখ’এবারে আক্ষরিক অর্থেই মনে হইতেছে বারো মাসে তের পার্বণ পালন করিতে যাইতেছি। যদি আমরা ধারণ করিয়া থাকি ধর্ম যার যার উৎসব সবার। তবে কাহারও কাহারও এই বিষয়ে আপত্তি রহিয়াছে। উহারা বলিয়া থাকে ধর্ম অনুসারে উৎসব। অর্থাৎ যাহার যে ধর্ম সে অনুসারে সে উৎসব পালন করিবে। যাহারা এইরকম ভাবে, তাহাদিগকে এই লেখা পড়িতে বারণ করিব। যদিও ইহাতে আপত্তিকর কিছুই নাই। তবে এলার্জির ভাব হইতে কতক্ষণ? নোয়াখালীর মতো সাম্প্রদায়িক জায়গায় বাড়িয়া উঠিয়াও এই প্রৌঢ়ত্বে আসিয়াও ঈদের আনন্দ হৃদয়কে স্পর্শ করিয়া যায় ... ইহা অনুভব করিবার ক্ষমতা ঈশ্বর সবাইকে দেন নাই।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর হইতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বুঝিতে পারিল মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠন করিবার নিমিত্তে তাহারা যে আশায় পূর্ববাংলাকে দেড় সহস্র মাইল দূরে রাখিয়াও ( দুই অংশ বিভক্ত ভারত দ্বারা) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করিল, মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করিবার জন্য, সেই আশায় ছাই পড়িল। পূর্বপাকিস্তানে যখন প্রথম টিভি স্টেশন চালু করিল ( ১৯৬৫ সাল) তখনকার সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়া গায়িকা, যিনি এক কিংবদন্তি শিল্পীর দুহিতা, তাঁহার উপর ফরমান জারি হইয়াছিল টিপ পরিয়া টিভিতে গান পরিবেশন চলিবে না। ফেরদৌসী রহমান সাথে সাথে উত্তর দিয়াছিলেন তাহা হইলে আমি গাহিব না।
বর্তমান সময়ে আমরা এমন তেজোময়ী নারী বা নাগরিকদের দেখিতে পাই না। ইহা যে একটি দেশের সংস্কৃতি হইতে পারে কেহ ভাবিয়া দেখিল না। না তাহারা,যাহারা বাঙালিদের মানুষের মর্যাদা দিতে নারাজ ছিল,না তাহাদের পাচাটা দালালেরা, বাঙালি হইয়াও যাহারা বাংলার কৃষ্টিকে বুকে ধারণ করিত না। আরব দেশে আনন্দ উৎসবে উলুধ্বনি দিয়া তাঁহাদের উল্লাস প্রকাশ করিয়া থাকে। উহাতে তাঁহাদের বেদাত বলিয়া ওয়াজ করিতে কোনো মাওলানাকে শুনি নাই। ধারণা করি উহাদের এইরূপ কথা বলিলে নানাধরণের সমস্যা সৃষ্টি হইতে পারে। অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও ইসলাম ধর্মের সর্বোচ্চ তীর্থস্থানে যাইতে অপারগ হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে। ইদানীং কোনো কোনো আরব দেশে মন্দির নির্মাণ করিবার অনুমতি দেওয়া হইতেছে। সেখানে কাহারও ধর্মে দাগ পড়িতেছে মর্মে শুনিতে পাই নাই। যত সমস্যা আমাদের দেশে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর হইতে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকবর্গের টনক নড়িল। তাহারা বুঝিতে পারিল দুধ দিয়া কালসাপ পুষিবার ন্যায় ভুল করিয়া ফেলিয়াছে৷ তাহারা অন্য পথ ধরিল। ঠিক করিল বাঙালি সংস্কৃতি বলিয়া কিছু থাকিবে না। উহাকে বুলডোজার দিয়া ডলিয়া মাটির সাথে মিশাইয়া দিতে হইবে। ইহা মাথায় রাখিয়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং সমাজের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে গভর্নর ভবনে ডাকিয়া আনিয়া জানিতে চাহিল তাঁহারা কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনা করিতে পারেন না? বেওকুফ গভর্নর হয়তো বা জানিতও না এই রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকিয়া বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।
সে দেখিয়াছে বাঙালিরা বড়ো বেশি তাঁহার ভক্ত। যখন তখন তাঁহার গান গাহিয়া উঠে। হিন্দুর লেখা গান কেন গাহিতে হইবে? রাখিলই বা সে লম্বা দাঁড়ি। আদতে লোকটা যে হিন্দু ( রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন। তবে জানিয়া রাখা ভালো যে ব্রাহ্ম সমাজকে সনাতন ধর্মের শাখা বলা যাইতে পারে। উহা প্রবর্তন করিতে ধরণীতে কোনো অবতারের আগমন ঘটে নাই)। হিন্দু শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে একাংশ সনাতন ধর্মকে যুগের সাথে তাল মিলাইয়া আধুনিক ধর্মে পরিণত করিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহারা নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাস করিতেন। সনাতন ধর্মেও নিরাকার ও সাকার দুইভাবেই ঈশ্বরের আরাধনা করা যায়।
তবে সাকার বলিতে ঠাকুরের ছবি বা প্রতিমা গড়িয়া পূজা করিবার কারণ হিসাবে হিন্দু পন্ডিতগণ ঈশ্বরকে একাগ্র মনে ডাকিবার সময়ে নয়ন সন্মুখে কোনো একজন উপাস্যকে রাখিয়া আরাধনা করিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিয়া থাকেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন আমি অনুমতি দিয়াছি বলিয়াই উঁহারা তোমাদের পূজা গ্রহণ করেন। তবে মূল কথা হইল " সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া কেবল আমাতেই শরণাগত হও।আমি তোমাকে সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত করিব " (কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলিয়াছিলেন)। ইহার অর্থ হইল সনাতনধর্মেও একেশ্বরবাদীতে বিশ্বাসী। বাকি যাঁহাদের পূজা করা হইয়া থাকে তাঁহারা কেহই ঈশ্বর নহেন। তাঁহাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি করা হইয়াছে। আবার তেত্রিশ কোটি দেবদবী বলিয়া যাহা বলা হয় তাহা হইল তেত্রিশ প্রকারের দেবদেবী। সংস্কৃতে কোটি শব্দের অর্থ হইল সংখ্যা।
এতখানি পড়িয়া আপনারা গালে হাত দিয়া দয়া করিয়া ভাবিতে বসিবেন না যে সনাতন ধর্মের প্রচার করার নিমিত্তে ইহা লেখা হইতেছে । মোটেই তাহা নহে। ঐ যে বলিয়াছিলাম বারো মাসে তেরো পার্বণ অথবা ধর্ম যার যার উৎসব সবার... এই কথার প্রেক্ষিতে ইহাই বুঝাইতে চাহিয়াছি এই বৎসর ঈদের আনন্দ কাটিতে না কাটিতে বাংলা নববর্ষ আসিয়া হাজির হইল। অনেক বছর যাবত বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা লইয়া একশ্রেণির মানুষ (!) পানি ঘোলা করিয়া চলিতেছে।
২০০১ সালে রমনা বটমূলে এর আগের শতক হইতে চলিয়া আসা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সময়ে বোমা হামলা হইয়াছিল। ইহাতে অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য আগতদের মধ্যে কয়েকজন নিহত হইয়াছিলেন। কেহ বা পঙ্গুত্ব বরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাংলা নববর্ষ উদযাপন কেহ বন্ধ করিতে সক্ষম হন নাই। যতদিন বাঙালি জাতি বাঁচিয়া থাকিবে, ততদিন ইহা চলিতে থাকিবে৷ ধর্ম এবং জাতিসত্তা যে ভিন্ন জিনিস তাহা বুঝিতে হইবে। ধর্মীয় উৎসব পালন করিতে কেহ বাধা প্রদান করিতেছে না। তাহা হইলে আমাদের জাতির যে বৈশিষ্ট্য উহা পালন করিতে সমস্যা কেন থাকিবে?
সমস্যা অবশ্য গুটিকতক মানুষকে লইয়া। গুটিকতক বলিয়া বিষয়টিকে হালকা করিয়া দেখিবার কোনো উপায় নাই। ইহাদের মধ্যে পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা, মোনায়েম খান, সবুর খান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রেতাত্মারাও রহিয়াছে। দিনে দিনে ইহাদের সংখ্যা বাড়িতেছে কোনো না কোনো মুখোশের আড়ালে। সময় হইয়াছে সমাজের বুদ্ধিজীবী দিকপালদের কেবলমাত্র বক্তৃতা বিবৃতিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রাখিয়া বাঙালির কৃষ্টি সংস্কৃতির ওপর ষড়যন্ত্র রুখিয়া দিবার জন্য তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করার মহান কাজে নিজেদের নিয়োজিত করিবার। যেমন করিয়া সুফিয়া কামাল, সনজিদা খাতুন, কলিম শরাফি, কামাল লোহানি, মোখলেসুর রহমান ( সিধু ভাই) ওয়াহিদুল হক প্রমুখরা ষাটের দশকে মোনায়েম খানদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করিয়া ১৯৬১ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ১৯৬৪ সালে তাঁহারা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষ উদযাপন করিয়াছিলেন। ইহা অদ্যাবধি চলিতেছে।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন করাকে কেন যে একশ্রেণির মনুষ্য আকারের প্রজাতি হিন্দুয়ানি বলিয়া প্রচার করিয়া থাকে উহা এতদিনেও বুঝিতে পারি নাই। এইদিন হিন্দুদের বিশেষ কোনো পূজার আয়োজন নাই। বাংলা সাল গণনা সম্রাট আকবরের সময় হইতে শুরু হয়। ইহার পিছনে অনেক বৃত্তান্ত রহিয়াছে।
বারোমাসে তের পার্বণে ঈদকে যুক্ত করিয়া গণনায় আনিয়াছি। সনাতন ধর্ম হইতে দুইটা পার্বণ বাদ দিয়া ঈদকে যুক্ত করায় আশা করি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনোকষ্টে ভুগিবেন না। হিসাব করিয়া দেখিতে পারেন হিন্দুরা কী আদৌ বারোমাসে তেরটি উৎসব পালন করিয়া থাকে? হিন্দুদের অনেক ধরনের পূজা অঞ্চল ভিত্তিকও হইয়া থাকে। তবে পার্বণ অর্থ হইল উৎসব, পূজা নহে৷ অতএব ঈদকে তের পার্বণের দুইটি ধরিলে প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা ' ধর্ম গেল ধর্ম গেল' বলিয়া পঞ্চম সুরে তান ধরিবেন না। আসলে আমরা যদি নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় অন্তরে রাখিতে পারিতাম এবং মুখে ও আচরণে মানুষ বলিয়া ভাবিতে পারিতাম তাহা হইলে অনেক সমস্যার সমাধান হইয়া যাইত। কিন্তু উহা আদৌ হইবে কী?
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও পরিব্রাজক।