মিয়ানমার কেন গৃহযুদ্ধের দেশ হয়ে উঠেছে!
মিয়ানমার বহু ভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠীর একটি দেশ। আবার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও অন্যান্য দিকগুলির ভিন্নতা। এই ভিন্নতার কারণে দেশটিতে প্রায়শ জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের দিকে নিয়ে যায়। বিশেষ করে মিয়ানমার সরকারের জাতিভিত্তিক নীতিই গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
মিয়ানমারের আয়তন আনুমানিক ৬ লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৫৪ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন (প্রায়)। দেশটিতে মোট ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং যারা ১০০টিরও বেশি ভাষায় কথা বলেন। আয়তনে বড় হলেও এটি একটি কেন্দ্রশাসিত দেশ। এখানে বার্মিজ জাতীয়তাবাদ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
উত্তর মিয়ানমারে মূলত কাচিন, কারেন এবং রাখাইনের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুদের বসবাস। এই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে বিভক্ত ছিল এবং তাদের নিজস্ব অনন্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে।
রাষ্ট্র জাতিগত গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সমান আচরণ করতে ব্যর্থ। দেশটির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সামরিক সরকারের হাতে, যা সামরিক সরকার এবং স্থানীয় জাতিগত সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে অসংখ্য দ্বন্দ্বের কারণগুলোর একটি। মিয়ানমারে এক ডজনের মতো সশস্ত্র শক্তিশালী গোষ্ঠী রয়েছে। দেশটির সরকার প্রকৃতপক্ষে ৭টি প্রদেশ এবং ২টি শহর নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি ৭টি রাজ্য, যেখানে জাতিগত সংখ্যালঘুরা রয়েছে, সেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ঠিক এই কারণেই মিয়ানমার বিভক্ত হওয়ার পরিস্থিতির দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে বিভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল। এগুলোর প্রতিটির নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু সামরিক জান্তার 'বার্মিজ জাতীয়তাবাদ' নীতি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
[তৎকালীন 'বার্মা' ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সাল থেকে দেশটিতে সামরিক শাসন শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে জান্তা সরকার দেশটির নাম 'বার্মা' থেকে মিয়ানমার করে। এখানে বলে রাখা ভালো, এখানে সত্যিকারের নাম পরিবর্তন করা হয়নি। কেবল নামের বানানটিকে স্থানীয় ভাষার আধুনিক উচ্চারণ ও বানারীতির মতো করে নেওয়া হয়েছে। 'বার্মা' এবং 'মিয়ানমার' দুটি শব্দর উৎস মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী– “ম্রন-মা” (မြန်မာ) থেকে। বর্তমানে অধিকাংশ বর্মির উচ্চারণে 'র' 'ইয়-তে পরিণত হয়েছে। সে কারণে 'ম্রন-মা' উচ্চারিত হয়, 'মিয়ান-মা'। ইংরেজি (মূলত রোমান) বানানে Myanmar. 'রেঙ্গুন' থেকে 'ইয়াঙ্গন'ও সেই একইভাবে এসেছে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে এর নাম আবার পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘The Republic of the Union of Myanmar]
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর মিয়ানমার সরকার জাতিগত কিছু নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই নীতিগুলি কখনোই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে, জাতিগত সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। জাতিগত এই নীতিগুলির মধ্যে একটি হলো- ‘বৃহত্তর বার্মা নীতি’। এই নীতির মূল ধারণাটি হলো, মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে বৃহত্তর বার্মার সাংস্কৃতিক বৃত্তে একীভূত করা। আর এইভাবে দেশের ঐক্য ও স্থিতিশীলতা অর্জন করা। কিন্তু এই নীতি জোর করে আত্তীকরণ (Assimilation) এবং সাংস্কৃতিক গণহত্যার মতো উপায়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দমন ও বৈষম্যের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়। ফলে এই নীতি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ ও প্রতিরোধের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। এতে করে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
এছাড়াও মিয়ানমার সরকার আরো কিছু জাতিগত নীতি বাস্তবায়ন করে, যেমন ‘ফেডারেলিজম’ এবং ‘বহুদলীয় ব্যবস্থা’। এই নীতিগুলির মূল উদ্দেশ্য হলো- প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার অনুমতি দেওয়া৷ তবে বাস্তবে এই নীতির বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব থেকেছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে গুণগত পার্থক্য অনেক বেশি। এই কারণে প্রকৃত সাম্য ও স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন হয়ে যায়। এ সব কারণে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে তীব্রতর করেছে।
মিয়ানমার সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল হলো, 'কারেন' জনগোষ্ঠীকে জোর করে আত্তীকরণ নীতি। কারেন জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের এই আত্তীকরণ নীতি অনেক দিক থেকেই প্রকাশ পায়।
প্রথমত, সরকার কারেন জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব ভাষা এবং হরফ ব্যবহার করার ওপর বাধানিষেধ আরোপ করে বার্মায় আত্মীকরণ করার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়ত, কারেনদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা। একইসঙ্গে কারেন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। এছাড়া তাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হতে বঞ্চিত বাধ্য করা হয়। অথচ কারেন মিয়ানমারের বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটি। এদের জনসংখ্যা ১ মিলিয়নেরও বেশি। এই জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতির ওপর সরকারের বিধিনিষেধের ফলে কারেনদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
কারেন জনগোষ্ঠী ছাড়াও মিয়ানমারের শান, কাচিন, আরাকান, রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুরাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি। তারা তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার প্রয়াসে অনেক প্রতিবাদ ও সশস্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মিয়ানমারে জাতিগত ইস্যু শুধু রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমস্যা। সরকারের উচিত প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করা এবং তাদের সমান অধিকার ও সুযোগ দেওয়া। তাহলেই মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব!
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী- লেখক ও গবেষক, পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম