নারী! আমি তো সবই পারি

  • সায়েম খান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

পৃথিবীতে মানুষের মাঝে আসল দ্বন্দ্ব শুরু হয় কর্তৃত্ববাদ নিয়ে। কে কাকে শাসন করবে অথবা কে কাকে শোষণ করবে। আমরা যদি কর্তৃত্ববাদের কথাই বলি, তাহলে খুব প্রাচীন ইতিহাস থেকে দেখতে পারি নারীর কর্তৃত্ববাদের প্রথা শুরু হয়েছিল সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে। আদিম সভ্যতার পরিবার গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে নারীদের অনবদ্য অবদান। সেই সব পরিবার ছিল নারীশাষিত। নারীদের সিদ্ধান্ত প্রাধান্য বিস্তার করতো পরিবারে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে আদিম সভ্যতার সেই নারী তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার  ধারাবাহিকতা নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে তৈরি হয় এক নতুন সমাজব্যবস্থা যাকে আমরা বলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। পুরুষের তন্ত্রে-মন্ত্রে ও পেশি শক্তির বলে দ্রোহের শিকার হতে থাকে নারী। ভূলুণ্ঠিত   করা হয় নারীর সকল অধিকার। চার দেয়ালে আবদ্ধ নারীর পৃথিবী হতে থাকে সংকীর্ণ। নারীর জীবনবোধ মানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক বাধ্যগত চরিত্র। নারী বঞ্চিত হতে থাকল শিক্ষা থেকে, বৈষয়িক সম্পদ থেকে।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মধ্যযুগে নারীরা প্রবঞ্চনার শিকার হয় সবচাইতে বেশি। মধ্যযুগীয় কায়দায় নারী হয়ে যায় ভোগ বিলাস ও বিনোদনের উপাদান। এরই ক্রমবর্ধমান ধারায়, নারীর জন্য মধ্যযুগের নব্য পেশা হিসেবে দাঁড়ায় পতিতাবৃত্তি। তারপর ধর্মের ধোয়া তুলে নারীর জন্য  শুরু হয় সতীদাহ প্রথা। প্রেম ও পাপের অদ্ভুত মিশেলে গড়ে ওঠে মধ্যযুগীয় নারী চরিত্র। পুরুষ তার পাপের আস্তরণ দিয়ে যে নারীকে পাপী করে গড়ে তোলে, আবার সেই নারীকেই আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে তাকে বানায় সতী। সমাজের এই অদ্ভুত কুসংস্কারাচ্ছন্ন রূপের প্রভাব বিস্তার করে নারী মনে। শুরু হয় নারীমুক্তির সংগ্রামের জয়গান। জেন্ডার ইকুয়ালিটি আর ফেমিনিজমের ধারা প্রবর্তনের আন্দোলন শুরু হয় আঠারশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। নারী চায় অবারিত শান্তি, তার মনের মাঝেও বাস করে বেঁচে থাকার উদাত্ত বাসনা। আকাশের বিশালতার মাঝে তাকিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার তারও আছে। শক্তি ও ভক্তির প্রচ্ছন্ন ছায়া হয়ে নারীর বিচরণ হয় স্বর্গে ও মর্ত্যে। পৃথিবীর প্রধানতম ধর্ম গ্রন্থ গুলিতে নারীকে তুলে ধরা হয়েছে উচ্চমার্গে। পূজনীয় এ নারীর শোচনীয় হার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা মেনে নিলেও, মেনে নেয়নি প্রকৃতি।

বিজ্ঞাপন

আজ ৮ মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। নারীর কল্যাণময়তায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় মূলত: পালিত হয় এই দিবসটি৷ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে নারীর মাঝে আজ নেই কোন মধ্যযুগীয় সংকীর্ণতা। নারী আজ অবারিত। মধ্য গগন থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ভ্রমণ কিংবা গমন করার ক্ষমতা ও জ্ঞান রাখে নারী। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নারী হয় উল্লাসিত। আর তাই নারীত্বের পূর্ণতা নারী খুঁজে পায় তার মাতৃত্বে। সৃষ্টির রহস্যের উৎস হিসেবে বিধাতা বিবেচনা করেন নারীকে।

সুসংহত হয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণতা নিয়ে নারী চায় পুরুষের সঙ্গী হয়ে থাকতে। আমরা অধিকাংশ পুরুষেরা হয়তো নারীর সেই চাওয়াটুকুই বুঝতে চাইনা। আত্মকেন্দ্রিকতার ছাঁচে গড়ে ওঠা পুরুষের মনে তখন আওড়ায় নারী বুঝি যায় উশৃঙ্খলতায়। আর এখান থেকে শুরু হয় নারী-পুরুষের বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা। ভোগবাদী, পুঁজিবাদী কিংবা সাম্যবাদী যেকোনো সমাজ ব্যবস্থায় আমরা নারীকে দেখেছি পুরুষের বিলাসী পণ্য হতে, হতে দেখেছি সেবাদাসী হতে। আধুনিক সমাজ সংস্কারের নিমিত্তে এই ভাবনা থেকে বিরত থাকা উচিত। নারীকে অবদমিত করে পুরুষের বীরোচিত জীবন কখনো রচিত হয় না। বরঞ্চ পুরুষের বীরত্ব গাথায় নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে নারী। 

ধর্মের নানা অনুকূলেও নারীর অবস্থান সুউচ্চে। ঋগ্বেদে নারী শক্তিকে মহাবিশ্বের সারমর্ম হিসাবে ঘোষণা করেছে। তেমনি পবিত্র কোরআনে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও মুল্যায়ন সম্পর্কে সুরা নিসা সহ অন্যান্য সুরার বহু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথিবীর যেকোন ধর্মে নারীকে নিয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা কিছু বেসিক বিষয় জানতে পারি। তা হলো, একটি সুশৃঙ্খল ও উদারপন্থী নারী অধিকারের কথা, যেখানে নারীর কোন মর্যাদাহানি, অসম্মান ও অবমুল্যায়ন হবেনা।

ঈশ্বরের এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি নারী। তাই নারীর সুপ্ত শক্তি দিয়ে সে জয় করে পুরুষ, পৃথিবী ও প্রকৃতি। নারীর অবয়বে সেই শক্তির প্রকাশ থাকে উহ্য। এর প্রকৃত উদাহরণ পাওয়া যায় নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের “এ ডলস হাউজ” নাটকের নোরা চরিত্রে। যা কিনা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার নারীর শেকল ভাঙ্গার গানে পরিণত হয়েছিল। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী আজ সর্বাংসহা। নারী চাইলেই সবই পারে। তাইতো বলা হয়

‘নারী! আমি তো সবই পারি। “

লেখক ও কলামিস্ট