স্বাধীনতা দিবসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ

  • প্রভাষ আমিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালি ওপর। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সে অপারেশনের লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মানুষকে হত্যা করা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করা।

পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থলগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট। রাজারবাগের পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর (বর্তমানে বিজিবি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল এবং অতি অবশ্যই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন।

বিজ্ঞাপন

সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদাররা। যাওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণার তারবার্তা পাঠিয়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়েছে ২৬ মার্চ। তাই ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতের স্মৃতি বেয়ে আসে ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ। স্বাধীনতা দিবস বাংলাদেশের অন্যতম উৎসবের দিন হলেও প্রথম স্বাধীনতা দিবসে উৎসবের পরিবেশ ছিল না। একাত্তরের ২৬ মার্চের সকালটির যে বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শীরা দেন, তাতে ঢাকা ছিল শ্মশানের মত নীরব। এখানে সেখানে লাশের স্তূপ আর ধ্বংসের চিহ্ন। কারফিউতে বন্দী ছিল উদ্বিগ্ন মানুষ।

১৯৭২ সাল থেকেই ২৬ মার্চ আমাদের আনন্দের দিন। নানান আয়োজনে দিনটি উদযাপিত হয়। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢল নামে সাধারণ মানুষের। এছাড়া প্যারেড গ্রাউন্ডের মার্চপাস্টসহ রঙিন সব আয়োজনে মুখর বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

একাত্তর সালের পর সম্ভবত এবারই প্রথম স্বাধীনতা দিবসে অবরুদ্ধ গোটা বাংলাদেশ। এমন দিন বাংলাদেশে কখনোই আসেনি, কামনা করি আর কখনো না আসুক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আগে থেকেই। পরে সরকারি-বেসরকারি সব অফিসেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয় নিরাপদে ঘরে থাকার। কিন্তু করোনার ছুটিকে ঈদের ছুটি বানিয়ে করোনার নিরাপত্তার কোনো নিয়ম না মেনে মানুষ দলে দলে বাড়ি ফিরতে থাকে। বাধ্য হয়ে সরকার একে একে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়। ২৩ মার্চ থেকে নৌ, রেল এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগও। স্বাধীনতা দিবস থেকে তাই কার্যত বাংলাদেশ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হয়েছে স্বাধীনতা পদক দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনাও বাতিল হয়ে গেছে। এখন সবার একটাই দায়িত্ব নিজ নিজ ঘরে অবরুদ্ধ থাকা।

রাষ্ট্রীয় এই অবরোধ জনগণের স্বার্থেই। এই স্বার্থটা না বুঝে যাতে কেউ ঘরের বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য মাঠ পর্যায়ে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আমাদের সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে ঘরে থাকার গুরুত্ব।

করোনা আতঙ্কের মধ্যেই স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রাজনীতিতে একটু স্বস্তি নিয়ে আসে বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির খবর। দুর্নীতির দু’টি মামলায় প্রায় ২৬ মাস তিনি কারাগারে ছিলেন। শেষ এক বছর ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিনে। এ সময়ে তার আইনজীবীরা বারবার আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তার যে সংগঠন বিএনপি এই ২৬ মাসে রাজপথে প্রতিরোধ তো অনেক দূরের কথা, একটা কার্যকর প্রতিবাদও জানাতে পারেনি। এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির সময় করোনা ঝুঁকি উপেক্ষা করে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার মানুষকে প্রশ্ন করতে মন চাইছিল, এতদিন কোথায় ছিলেন? ভয়ে কেউ রাস্তায় নামেননি, আর এখন করোনা ঝুঁকি নিয়ে এসেছেন শোডাউন করতে!

অনেকেই বলছেন, এতদিন সরকারের মন্ত্রীরা বলছিলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির এখতিয়ার আদালতের। তাই যদি হবে, তাহলে এখন মুক্তি দিল কীভাবে? এটা কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ? আর সরকার যদি মুক্তি দিতে পারেই, তবে এতদিন দেয়নি কেন? আসলে খালেদা জিয়ার মুক্তির চারটি উপায় ছিল। প্রথমত আদালত থেকে জামিন, দ্বিতীয়ত রাজপথে প্রবল আন্দোলনে সরকারকে বাধ্য করা, তৃতীয়ত, সরকারের কাছে প্যারোলের জন্য আবেদন করা, চতুর্থত, রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা ভিক্ষা। এখন সরকার যে বিবেচনায় খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করেছেন; সেই বিবেচনায় আদালতও তাকে জামিন দিতে পারতেন। কেন দেননি, সেটা আদালতই ভালো বলতে পারবেন। তবে জামিন দেয়া না দেয়াটা সম্পুর্ণই আদালতের এখতিয়ার। আর আন্দোলন করে দলের চেয়ারপারসনকে মুক্ত করার সামর্থ্য যে বিএনপির নেই, সেটা অনেক আগেই বোঝা হয়ে গেছে।

প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন ধরেই কথা হচ্ছিল, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। কারণ মুখে বললেও কেউ এতদিন আবেদন করেনি। কারণ বিএনপি প্যারোল নয়, জামিন চাইছিল। তাছাড়া আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া সরকারের অনুগ্রহের প্যারোলের ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন। কারণ এখানেও রাজনীতির মারপ্যাচ আছে। জামিন হলে বিএনপি কিছুটা পলিটিক্যাল মাইলেজ পেত, সেটা দিতেও রাজি হয়নি সরকার। সরকার অপেক্ষা করেছে। জামিনে মুক্তি সম্ভব নয় জেনে বিএনপি এ প্রক্রিয়া থেকে সরে যায়। এগিয়ে আসে পরিবার। তাদের আবেদনেই সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নির্দেশে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ এর ১ উপধারায় খালেদা জিয়ার দণ্ড ৬ মাসের জন্য স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে তিনটি শর্ত- কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না, বিদেশে যেতে পারবেন না এবং বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। শর্ত ভঙ্গ করলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হতে পারে। শর্ত মানলেও ৬ মাস পর জিয়াকে আবার জেলে যেতে হবে। তবে আমার ধারণা, ৬ মাস পর দণ্ডের স্থগিতাদেশ আবার বাড়ানো হবে। এই মামলা থেকে সরকার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সু্বিধা নিয়ে নিয়েছে। আদালতে জিয়াকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করতে পেরেছে। ২৬ মাস কারাভোগের পরও আপসহীন নেত্রীকে মুক্তি পেতে হয়েছে সরকারের শর্তে এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহে। এই পলিটিক্যাল অ্যাডভান্টেজ আওয়ামী লীগ নিতে চাইবে বারবার।

বলছিলাম স্বাধীনতা দিবসের কথা। একাত্তর সালে আমাদের কাছে আতঙ্ক ছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। আর এবারের শত্রু অদৃশ্য, অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস। চীনে আবিষ্কার হওয়া এই ভাইরাস আমাদের সবাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যারা ঘরে যেতে চাননি, তাদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে। একাত্তরে আমরা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের হারিয়ে বিজয় পেয়েছিলাম। এখন আমরা অন্যরকম এক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আছি। কিন্তু এ যুদ্ধে মানুষ বড্ড অসহায়। ছোট্ট ভাইরাস কুড়ে কুড়ে খায় আমাদের ফুসফুস, কেড়ে নেয় প্রাণবায়ু।

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি করোনা মোকাবিলায় নেয়া সরকারের নানান উদ্যোগের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তবে আমি সরকারের করোনা প্রস্তুতি নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নই। শুরুতে বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত নজরদারি ছিল না। করোনা টেস্টেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না, এখনও নেই। করোনা চিকিৎসায় আমরা এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নই। ডাক্তারদের প্রস্তুত করা হয়নি, তৈরি নয় হাসপাতালও। অথচ সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমরা আড়াই মাস সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা প্রায় কিছুই করিনি। আমার ধারণা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি ঠিকমত বোঝেনইনি, তাই শুরুতে খামখেয়ালি করেছেন। এখন বাংলাদেশের শেষ ভরসা শেখ হাসিনাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। তাই তিনি স্বাধীনতা দিবসে অবরুদ্ধ করে দিয়েছেন দেশ। কারণ তিনি জানেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার একটাই অস্ত্র- ঘরে থাকা। আপনারা সবাই ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। নিজে বাঁচুন, দেশকে বাঁচান। করোনার বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে অবশ্যই বাংলাদেশ জিতবে, বিশ্ব মানবতা জিতবে।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ