ক্ষমতার পালাবদলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে সৃষ্ট আস্থাহীনতার বড় প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। বিনিয়োগে ভাটার টান দেশের অর্থনীতির বহুমূখি সংকটকে যেমন প্রকট করবে, তেমনি কন্মসংস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও ঘনীভূত হবে। সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা এই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, ডলার সংকট, দফায় দফায় করকাঠামোর পরিবর্তন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট, উচ্চ সুদের হারসহ আরো নানা সমস্যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংকট সামাল দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু এতে এখনো তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ব্যবসা-বিনিয়োগ প্রসারের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ধারাবাহিক কমতে থাকা বিনিয়োগ তলানিতে নামতে সময় লাগবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্বল অর্থনীতির সূচকে আটকে গেছে ব্যবসার গতি। সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এবং আকাশচুম্বী সুদের চাপে পড়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা ব্যবসার জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কম থাকায় আমদানি সীমিত।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে এক হাজার ৮৩টি ব্যবসা প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩৩৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে। পরের বছর এক হাজার ৮১টি ব্যবসা প্রকল্প নিবন্ধনের মাধ্যমে এক হাজার ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল। ২০২৩ সালে আরো কমে ব্যবসার ৯৯৮টি প্রকল্পে ৮৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার হয়। আর চলতি বছরে ব্যবসার ৭৪২টি প্রকল্পে এক হাজার ১৬৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিবন্ধন হলেও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকেই ২৫৪ প্রকল্পে ৬৬৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনকালীন জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা কমে ১৮৬ প্রকল্পে মাত্র ১৮৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, আগামী দিনে পাঁচটি ইজেডকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারণ ১০০ ই-জেডে বিনিয়োগের অফার করার সক্ষমতা আছে কি না তা দেখতে হবে। ১০০ ই-জেড নির্মাণ থেকে আমরা সরে যাচ্ছি না। সীমিত আকারে বাস্তবায়ন করে এগোতে চাই। বিনিয়োগ আনতে হলে সরকারের সব বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে।
রিজার্ভের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বিদেশি বিনিয়োগ। রিজার্ভ যেমন কমছে বিদেশি বিনিয়োগও কমছে। আগের বছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে নেট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৮.৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে নেট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১৪৭ কোটি ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে যা ছিল ১৬১ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪ কোটি ২০ লাখ ডলার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০২৫ সালে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক দিক থেকে অস্থিরতা থাকবে। কারণ কয়েক বছর ধরে চলা সমস্যা—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, স্তিমিত বিনিয়োগ ও সীমিত কর্মসংস্থানের চাপ আছে। এ কারণে আগামী দিনে বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের গতি ধীর হবে। ফলে কর্মসংস্থান আরো চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যা কাটাতে আরো কিছু সময় লাগবে।’
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অগ্রগতির ওপর নির্ভর করবে বিনিয়োগ। বিশেষ করে বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাংকব্যবস্থা, বন্দরের সক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ বাজার ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতি নাজুক থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না। দেশের রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ দেখেই আসবেন উদ্যোক্তারা। দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে। গত নভেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৬৬ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিনিয়োগের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে প্রধান উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। এতেই দেশে নতুন বিনিয়োগ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
সিপিডি-র সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। ২০২৪ সালে প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকেই ব্যবসায়ের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতিসহ অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, উচ্চ করহারসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেন ব্যবসায়ীরা। এমন অবস্থায় বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা।
সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ মাসে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সংখ্যা নেহাত কম নয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ছোট-বড় মিলিয়ে কম্পানি বন্ধের পরিমাণ তিন শতাধিক। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এই দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেকে ব্যবসা সীমিত করেছেন। আবার অনেকে বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১৬টি কারখানা গত ডিসেম্বরে বন্ধ হয়েছে। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন আটটি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এস আলমের ছেলে আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া গ্রুপ এবং জামাতা বেলাল আহমাদের ইউনিটেক্স গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা কয়েকটি গ্রুপ অব কম্পানি বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে।
দেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগও শ্লথ। গত এক দশকে দেশে প্রায় ৯৮ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স গত নভেম্বরে বাংলাদেশের স্টার্টআপে বিনিয়োগের এক দশকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আসা বিনিয়োগের মধ্যে ৯২ শতাংশ বিদেশি। দুই বছর ধরে বিনিয়োগ কমার পেছনে বৈশ্বিকভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, যুদ্ধের প্রভাব, দেশীয় নীতির পাশাপাশি ডিজিটাল সেবা নেওয়ার বাজার বড় না হওয়াকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ছিল। বিশেষ করে ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা এবং চলমান বিভিন্ন যুদ্ধ ও সংঘাত উল্লেখযোগ্য। চলতি বছরের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে এর বড় প্রভাব থাকবে। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগের কোনো পূর্বাভাস মিলছে না।