বিপিসির কর্মকাণ্ড অজ্ঞতা নাকি দুরভিসন্ধিমূলক!
এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) টার্মিনাল নির্মাণে সংক্রান্ত বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ এটি নিছক অজ্ঞতা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলকে এলপিজি টার্মিনালের পরামর্শক নিয়োগ করার চিঠি দেওয়ায় এমন সমালোচনা শুরু হয়েছে। তরল জ্বালানি আমদানি ও বিপননের দায়িত্বে থাকা একমাত্র রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটির (বিপিসি) প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা বরাবরেই প্রশ্নবিদ্ধ। ইআরএল-২ এবং এসপিএম নির্মাণে বিলম্ব ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
দেশে লাফিয়ে বাড়ছে এলপিজির ব্যবহার। আমদানি নির্ভর এই জ্বালানির সাশ্রয়ী যোগান নিশ্চিত করতে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিশেষায়িত গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যাতে বড় জাহাজে করে এলপিজি আমদানি করা যায়। এমনটি হলে টন প্রতি পরিবহন খরচ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় করা সম্ভব। জ্বালানি বিভাগ মনে করছে এতে করে এলপিজি আরও কমমূল্যে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
টার্মিনাল নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার জন্য ১৯ নভেম্বর বিপিসিকে চিঠি দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। মাতাবাড়িতে ল্যান্ড বেইজ এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্যে অভিজ্ঞ পেট্রোবাংলা বা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লি.(আরপিজিসিএল) যেভাবে কনসালটেন্ট নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে, বিপিসিকেও অনুরূপ কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয় চিঠিতে। বিপিসি এই চিঠি পাওয়ার পর সবাইকে অবাক করে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি থেকে টামির্নাল ডেভেলপার সিলেকশন পর্যন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলকে দায়িত্ব দেওয়ার চিঠি দেয়।
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় ও বিপিসির যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে বিপিসির পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলে অনন্ত জ্বালানি বিভাগের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ করলে সেটি সুন্দর দেখাতো।
জ্বালানি বিভাগকে পাঠানো বিপিসির চিঠিতে বলা হয়েছে, “পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের অধিনস্থ পাওয়ার সেলের অনেক অভিজ্ঞতা ও এক্সপার্টিজ রয়েছে।” প্রস্তাবিত এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে বিপিসির নিজস্ব ‘এক্সপার্টিজ’ না থাকায় ফিজিবিলিটি স্টাডি থেকে টার্মিনাল ডেভেলপার সিলেকশন পর্যন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের পরামর্শক নিয়োগের কাজটি পাওয়ার সেলকে দেওয়ার অনুরোধ করা যাচ্ছে।
যদিও পাওয়ার সেল ইতোমধ্যে এ বিষয়ে না করে দিয়েছে। পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেন বার্তা২৪.কম’কে বলেছেন, আমাদের পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা বলেছি, এখনই এ বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। আমি জানিয়েছি, এ সংক্রান্ত কোম্পানি গঠন করা হোক। সেই কোম্পানি পরামর্শক নিয়োগ দেবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সেমিনারে এলপিজি অপরেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী বলেছেন, বর্ষা মৌসুমে এলপিজি আমদানি করা যায় না। একটি গভীর সমুদ্রবন্দর খুবই জরুরি। গভীর সমুদ্র বন্দর করার জন্য পাওয়ার সেলকে দেওয়া হয়েছে দায়িত্ব। কাজটি দেওয়া উচিত পেট্রোবাংলাকে। গভীর সমুদ্রবন্দর হলে পন্য আমদানি নিশ্চিত হবে। এলপিজির দরও কমে আসবে।
প্রস্তাবিত টার্মিনালটি হবে রেফ্রিজারেটেড মাদার টার্মিনাল। বার্ষিক অপরেশন ক্ষমতা হবে ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন। টার্মিনালের জেটিতে ৪০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে। টার্মিনালের ক্ষমতা হবে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। টার্মিনাল হতে দেড় থেকে চার হাজার টনের লাইটারেজ এলপিজি বাজারজাতকারি কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করা হবে।
এলপিজি টার্মিনালটি স্থাপনে তিন জাপানি কোম্পানি পৃথক তিনটি কনসোর্টিয়াম স্ব স্ব প্রস্তাব কাছে জমা দিয়েছে। জাপানি কোম্পানি মিতসুই অ্যান্ড কোং লিমিটেডের নেতৃত্বাধীন একটি কনসোর্টিয়াম বিল্ড-ওউন-অপারেট (বিওও) ভিত্তিতে মাতারবাড়ি এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। এই কনসোর্টিয়ামে যুক্ত করা হয় এস কে গ্যাস নামে একটি কোরিয়ান কোম্পানিকে, যারা বৃহদাকার গ্যাস ক্যারিয়ারের (ভিএলজিসি) মালিক। স্থানীয় পার্টনার হিসাবে যুক্ত হয় ইস্ট কোস্ট গ্রুপকে। মিতসুই গ্রুপের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর আলোচনার চুক্তি করার আগে জাপানের আরেকটি সংস্থা মারুবিনি কর্পোরেশনের কাছ থেকেও এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব পায় জ্বালানি বিভাগ। মারুবিনি ভিটল নামে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক একটি কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করে। সম্প্রতি সুমিতোমো নামে আরেকটি জাপানি কোম্পানি এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের প্রস্তাব জমা দেয়। পরামর্শক এ প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন করবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কোন সুপরিশ বা মতামত না দিয়েই সিদ্ধান্তের জন্য মিতসুই এবং মারুবিনির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফাইল ফেরত পাঠিয়ে প্রস্তাব দুটি তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দিতে হয়েছে বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১.২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩ মিলিয়ন ও ২০৪১ সালে এলপিজির চাহিদা হবে ৬ মিলিয়ন টন। সরকার ৫৬ কোম্পানিকে লাইসেন্স দিয়েছে এরমধ্যে ২৮টি কোম্পানি অপরেশনে আছে, আর ২০ কোম্পানি আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ২’শ ট্যাংকার, ৫ হাজার ট্রাক, ২১টি লাইটারেজ ভ্যাসেল ও ২০টি স্যাটেলাইট প্লাট রয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মুহা শের আলী বার্তা২৪.কম’কে বলেছেন, গত ১০ বছরে ব্যাপক আকারে এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি হারে (৯২ শতাংশ) বেড়েছে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে। আর গড় ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে এলপিজি ব্যবহার। ৫৬টি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করছি এসব যদি অপরেশনে আসে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আর কোনো সংকট হবে না।