অস্থির এলপিজির দর, সংকটে বিইআরসি
অস্থির হয়ে উঠেছে এলপি গ্যাসের (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) আন্তর্জাতিক বাজারদর। গত তিন মাসের টন প্রতি দর বেড়েছে প্রায় ২’শ ডলার মতো। বাড়ন্ত এই দর কয়েক বছরের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রপেন এবং বিউটেনের সংমিশ্রণে প্রস্তুত এলপি গ্যাসের উচ্চমূল্যের রেকর্ড ছিল ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে। ওই সময়ে প্রপেন ও বিউটেনের টন প্রতি দর উঠেছিল ৬৫৫ ইউএস ডলার। ওইটাই ছিল এলপি গ্যাসের সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ দরের রেকর্ড। কিন্তু এরপরের মাস থেকে দর কমতে থাকে। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরে ৩৫০ ডলারে নেমে আসে। এরপর শীতে আবার বাড়তে বাড়তে (২০২০ সালে জানুয়ারি) প্রপেন বিউটেন যথাক্রমে ৫৬৫ ও ৫৯০ ডলারে বেচাকেনা হয়।
পরের মাস থেকেই পড়তে থাকে এলপিজির দর। করোনার ধাক্কায় কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরের রেকর্ড করা হয় (এপ্রিল-২০২০) ২৩০ ডলার। পরের মাস থেকে ৫ থেকে ১০ ডলার করে বাড়লেও নভেম্বরে একমাসে ৫৫ ডলার বৃদ্ধি পেয়ে দর দাঁড়ায় ৪৩০ ডলারে। পরের মাসে ২০ ডলার বাড়লেও জানুয়ারিতে পুরোপুরি ১০০ ডলার দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫০ ডলারে। এলপিজির দরের সুচক ঘেটে দেখা গেছে বরাবরেই শীতকালে দর থাকে ঊর্ধ্বমূখী।
ঊর্ধ্বমূখী দরের কারণে সারাদেশের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারদরের ধুয়া তুলে খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। পাইকারি পর্যায়ে ৭৫০ টাকার সিলিন্ডার (১২ কেজি) ৯২০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। আর খুচরা বিক্রেতারা ১ হাজার থেকে ১১’শ টাকার বেচাকেনা করছে। হঠাৎ এই বাড়ন্ত দর নিয়ে ক্রেতারা যখন ক্ষিপ্ত ঠিক সেই সময়ে প্রথমবারের মতো ঘোষিত হতে যাচ্ছে দেশের এলপিজির বাজারদর।
এতোদিন পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। দর নির্ধারণের বিষয়ে অনেকদিন ধরেই কথা হলেও জ্বালানি বিভাগ, বিইআরসি নাকি বিপিসি করবে সে নিয়ে ছিল রশি টানাটানি। সর্বশেষ ক্যাবের এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোট বিইআরসিকে শোকজ করে। সে মোতাবেক ১৪ জানুয়ারি গণশুনানি গ্রহণ করে।
তবে ক্রেতারা যখন কম দামে পেয়ে অভ্যস্থ সে সময়ে সর্বোচ্চ দর বিবেচনা করে মূল্য ঘোষিত হলে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) উপর গ্রাহকদের অনাস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তাদের মনে এই ধারণা হতে পারে বিইআরসির কারণে দাম বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে বাজারে একটি কথা প্রচলিত হয়েছে যে, দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই কৃত্রিম উপায়ে দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। সে কারণে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বিইআরসি উভয় সংকট রয়েছে, একদিকে গণশুনানির পর ৯০ দিনের মধ্যে আদেশ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা অন্যদিকে দ্রুত মূল্য নির্ধারণে কোর্টের একটি আদেশ রয়েছে। আবার দাম যে সহসা কমবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই, এমনকি বাড়তেও পারে। বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে তারা ফেব্রুয়ারি শেষ কিংবা মার্চের প্রথমার্ধে দর ঘোষণা করতে চান। ভোক্তা, আমদানিকারক, এবং খুচরা বিক্রেতা সবার স্বার্থ রক্ষা করা হবে।
শুনানিশেষে কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেছিলেন, “আগামী সাতদিনের মধ্যে লিখিত মতামত দেয়া যাবে। এরপর আবার ছোট পরিসরে বসে দামের বিষয়ে মূল্যায়ন করে যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত দামের আদেশ দেবে কমিশন”।
দেশে ব্যবহৃত এলপিজির সাড়ে ৯৮ ভাগ আমদানি নির্ভর। সরকারি (বাংলাদেশ এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) কোম্পানির মার্কেট শেয়ার মাত্র দেড় শতাংশ। সরকার এখন পর্যন্ত ৫৬টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ২৮টি মার্কেটে রয়েছে ২০টি প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে আবার একেকটি কোম্পানি একেক মার্কেট থেকে আমদানি করছে। কেউ আনছেন দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির আওতায়, কেউ কেউ স্পর্ট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে। এতে করে আমদানি পর্যায়ে দরের হেরফের হচ্ছে।
অনেক দিন ধরেই একটি বিষয় আলোচিত ছিল কেউ পাইপ লাইনে কমদামে গ্যাস পাবে। অন্যরা বেশি দামে এলপিজি কিংবা লাকড়ি ব্যবহার করবেন এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই বিষয়টিতে সমতা আনার জোর দাবি ছিল। ক্রস সাবসিডির বিষয়টি বিইআরসির এক রিপোর্টে সামনে এসেছে। জ্বালানি বিভাগে পাঠানো একটি চিঠিতে সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি সরবরাহের জন্য আমদানি পর্যায়ে ২৫ শতাংশ ভর্তুকির দেওয়া সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে পাইপলাইনের গ্যাসের গ্রাহকদের উপর চার্জ বসিয়ে ভর্তুকির অর্থ যোগান দেওয়া সম্ভব।
এলপিজির দর নির্ধারণে এনার্জির কষ্ট অর্থাৎ আমদানিকৃত এলপিজির মূল্য, আরেকটি থাকবে পরিবহন খরচ, কোম্পানির ও পরিবেশকের মুনাফা এবং অন্যান্য। আরামকোর দরের সঙ্গে শুধু এনার্জি দর উঠানামা করবে। আর অন্যান্য কষ্ট অপরিবর্তিত রাখতে চায় বিইআরসি।
দরের মতো একেক কোম্পানি একেক মিশ্রণে বাজারজাত করছে। বাংলাদেশের একশ বছরের তাপমাত্রা রেকর্ড অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪৫ ডিগ্রি, সর্বনিম্ন ২.৬ তাপমাত্রার রেকর্ড রয়েছে। তাপমাত্রা অনুযায়ী গৃহস্থালী ও যানবাহনে ব্যবহারের প্রপেন ৩০ হতে ৪০ শতাংশ এবং বিউটেন ৭০ থেকে ৬০ শতাংশ উপযোগী হবে বলে বিইআরসির রিপোর্টে বলা হয়েছে।
২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ টন ও ২০৪১ সালে চাহিদা হবে ৬০ লাখ টন।