‘কাজ না করলে পয়সা বেশি’
খনিজ সম্পদ খাত সম্পর্কে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, ‘কাজ না করলে পয়সা বেশি’। কথাটি দু’একজনের মাথার উপর দিয়ে গেলেও বেশিরভাগই মাথা নেড়ে সায় দিলেন, কারণ তারা রসায়নটা জানেন।
একজন প্রশ্ন করলেন কিভাবে? এবার বক্তা বললেন এই যে, ভোলার তিনটি কূপ খনন করার কথা বাপেক্সের। তারা খনন করলে সর্বোচ্চ ১৮০ কোটি টাকা খরচ হতো। বাপেক্স কি এই ডিপিপি অনুমোদনের জন্য কাউকে (পেট্রোবাংলা কিংবা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ) ঘুষ দিবে! সেই কাজ এখন গ্যাজপ্রমকে দেওয়া হচ্ছে এতে ব্যয় হবে ৬০০ কোটি টাকার উপরে। বাড়তি ৪৮০ কোটি টাকা কোথায় যাবে, অনেকের পকেটেই এর ভাগ চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে! তাহলে সারমর্ম কি দাঁড়ালো, কাজ না করলে ব্যক্তিগতভাবে অনেকের লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি।
শ্রীকাইলে-৪ কূপ খনন করার জন্য বাপেক্স ৪৮কোটি টাকার ডিপিপি তৈরি করেছিল। সেই ডিপিপি বোর্ডে অনুমোদনও হয়। সেই ডিপিপি প্রেরণ করা হয় পেট্রোবাংলার অুনমোদনের জন্য। পেট্রোবাংলা অনুমোদন না করে প্রায় ২০০ কোটি টাকায় গ্যাজপ্রমের জন্য ডিপিপি করার নির্দেশ দেয়। কর্তার ইচ্ছায় কাজ, বাপেক্স ২০০ কোটি দিয়ে গ্যাজপ্রমের মাধ্যমে কূপ খনন করায়। কেনো এটি হলো বলতে পারেন। বাড়তি দেড়’শ কোটি টাকা কাদের পকেটে গেছে একবারও খোঁজ নিয়েছি আমরা।
আবার দেখেন, সিলেট অঞ্চলের পর গ্যাসের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ ধারণা করা হচ্ছে ভোলা অঞ্চলে। এই অঞ্চলে যেখানেই কূপ খনন করা হচ্ছে সেখানেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। তেমন একটি ফিল্ড থেকে বাপেক্সকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। ফিল্ডটি রাশান কোম্পানি গ্যাজপ্রম ইজারা নিতে চায়। এখানে যদি বাপেক্স কাজ করে তাহলে ব্যাক্তি বিশেষে পকেট ভারি করার সুযোগ নেই। কিন্তু রাশানদের দিলে অনেকের পকেটে মোটা কমিশন চলে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তার অর্থ কি দাঁড়ায়, কাজ না করলেই টাকা বেশি। আর কাজ করলে শুধু তাদের বেতনটাই পাবেন। গ্যাজপ্রমের কাজ মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তিনগুণ দরে কূপ খনন করা হলেও প্রায় ক্ষেত্রেই ২৫ থেকে ৩০কোটি টাকা ব্যায়ে ওয়ার্কওভার করতে হচ্ছে। তারপরও কেনো তাদেরকে কাজ দেওয়া হয় বলতে পারেন?
আবার আরেকটি মহাআত্মঘাতী কাজ চলছে। কাজ না করে হাত গুটিয়ে থাকলে সংকট তৈরি হবে, সেই সংকটকে পুঁজি করে অনেক কিছু হয়। এখন যেমন গ্যাস নেই বলে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এতেতো কেউ না কেউ ব্যাবসা করছেই। দেখেন এক সময় বলা হলো বাংলাদেশ গ্যাসর উপর ভাসছে, সেটিও বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রচারনা ছিল এখন এ কথা প্রমাণিত। ইউনোকল তখন দিল্লিতে গ্যাস রপ্তানি করতে চেয়েছিল, তারই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে এই প্রচারণা বাজারে ছেড়েছিল। এখন গ্যাস সংকটের ধুয়া তোলা হচ্ছে এর পেছনেও বিশেষ কারসাজি চলে। তাই খালি চোখে অনেক কিছু দেখি যার পেছনে চলে বড়দের খেলা।
সমুদ্রসীমা জয়ের মাধ্যমে সাগরে বিশাল অঞ্চলে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের পাশের ব্লকগুলো থেকে মায়ানমার বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করছে। আর বাংলাদেশ অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। বলা হচ্ছে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত ডাটা নেই কারণে বহুজাতিক কোম্পানি আগ্রহি হচ্ছে না। মাল্টিক্লেইন সার্ভে করার পর পর্যাপ্ত ডাটা সামনে এলে অনেকে আগ্রহী হবেন। মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার এই বক্তব্য মানতে নারাজ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছে আমাদের কাছে যে ডাটা রয়েছে তাতেই অনেকে আগ্রহী হতেন। কিন্তু সেসব ডাটা পেট্রোবাংলা সিলড করে রেখেছে। বিদেশি কোম্পানির কেনার কিংবা দেখার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের কাছে প্রচুর সাইচমিক সার্ভের ডাটা রয়েছে। নব্বইয়ের দশকেও এগুলো উন্মুক্ত ছিল, বিদেশি কোম্পানি এসে নিয়ে গিয়ে বিশ্লেষণ করে তারপর অংশ নিতেন। কিন্তু এখন সেসব ডাটা সিলড করে রাখা হয়েছে।তাহলে বিদেশি কোম্পানি আসবে কিসের উপর ভিত্তি করে। এই ডাটা সিলড করে রাখার কোনো অর্থ দেখিনা।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে ভোলা আবিস্কার করলো বাপেক্স, ২০১৮ সালে আরেকটি ফিল্ড আবিস্কার করেছে, বাপেক্স মনে করছে সাউথে যাবে। আমরা বাপেক্সকে থামিয়ে দিয়ে গ্যাজপ্রমকে নিয়ে আসলাম। এরমতো আত্মঘাতি আর কোনো বিষয় হতে পারে না। দেশীয় কোম্পানি প্রথম ধাপে সফল, দ্বিতীয় ধাপেও সফল, তৃতীয়ধাপে কাজ করতে চাইল আমরা দিলাম না। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে ১১টি গ্যাস ফিল্ড আবিস্কার করেছি। আর একই ভূ-কাঠামোতে পার্বত্য এলাকায় আমরা মাত্র ১৪টি কূপ খনন করেছি। ওরা কোথাও গেছে আর আমরা কোথায় পড়ে আছি।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোক্তাদির আলী এক সেমিনারে বলেছেন, যে ডাটা আছে সেটি দিবেন। মাল্ট্রি ক্লেইন সার্ভে নেই বলে বসে থাকবেন! আমার যেটি মনে হয় দশ-বারো বছর আগে মাল্টিক্লেইন সার্ভে কাজ শুরু করি। আরও বহুদিন চলে যাবে, কারণ বিভিন্ন গোষ্ঠি স্বার্থ এখানে কাজ করে। যে পরিমান ডাটা অ্যাভলেবল রয়েছে এটাকে যক্ষের ধন মনে করছি। টোটাল রেস্ট্রিকশন করে রাখা হয়েছে। প্রথমেতো তারা দেখবে, সেই দেখার সুযোগটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অবশ্যই ওপেন করে দেওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার সালেক সূফী বলেছেন, অফসোরে পিএসসি করতে গেলে পর্যাপ্ত ডাটা নেই। আমি এই কথা মানি না। ১৯৭৪ সালে যে কোম্পানিগুলো এসেছিল তারা এসে ডাটা রেখে গেছে। সেই ডাটাগুলো পেট্রোবাংলার হাতে রয়েছে এগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত।
পেট্রোবাংলার পরিচালক(পিএসসি)প্রকৌশলী শাহীনুর ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ডাটা দেওয়া হয় না এ কথাটা সত্য নয়। বিডিং রাউন্ডে যারা অংশ নেবে তাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে এসব ডাটা বিক্রি করা হয়। কি পরিমাণ তথ্য রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বেশ কিছু তথ্য রয়েছে বাপেক্স, পেট্রোবাংলার কাছে। এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না।
বাপেক্সের সাবেক এমডি মুতর্জা আহমেদ ফারুক বলেছেন, বাপেক্স নিজস্ব সিদ্ধান্তে কোনো কাজ করতে পারেন না। বরং জ্বালানি বিভাগ থেকে এবং পেট্রোবাংলা থেকে তাদের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সেখানে কিন্তু প্রোপার টেকনিক্যাল লোক নেই। প্রোপার লোককে প্রোপার জায়গায় বসানো উচিত। মূল বিষয় হচ্ছে সরকারকে চাইতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের আরো স্বাধীনতা দেয়া জরুরি।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ একাধিক সভায় বলেছেন, আমাদের হাতে যথেষ্ট ডাটা নেই কারণে অনেকে আগ্রহি হচ্ছেন না। তাই মাল্টিক্লেইন সার্ভে করা হচ্ছে। এই শিগগিরই শেষ হলে আশাকরি অনেক কোম্পানি আগ্রহী হবেন। প্রতিমন্ত্রীর এই কথাতেও অনেকে সন্দেহের গন্ধ খোঁজেন।