সরকারের বড় সাফল্য বিদ্যুতেই গলার কাঁটা হতে পারে!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

গ্যাসের বর্তমান সংকট সামাল দিলে বিপদজনক পথে হাটছে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। অতিরিক্ত উৎপাদন গ্যাস ক্ষেত্র ফিল্ডগুলোর মারাত্বক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

সাঙ্গু ও বাখরাবাদের মতো পরিণতি হলে, সামাল দেওয়ার মতো বিকল্প নেই সরকারের হাতে। সেই ধাক্কা ২০২৩ সাল নাগাদ আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। যখন দেশ থাকবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনমূখী। আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ঘরে ঘরে বিদ্যুতই এতে গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, গ্যাস কুপগুলোর সাধারণত একটি ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করা থাকে। বাংলাদেশের কূপগুলোর গ্যাস উত্তোলনের ক্যাপাসিটি রয়েছে প্রায় ৩০ এমএমসিএফডির মতো। কিন্তু কিছু কূপ থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত উত্তোলন করা হচ্ছে। বিষয়টি গ্যাস ফিল্ডের জন্য ভয়ানক হতে পারে। এ্মনকি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক নজির রয়েছে। আর এই নজির পেতে বিদেশ যেতে হবে না। বাংলাদেশের সাঙ্গু গ্যাস ফিল্ড এভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সাঙ্গুর উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১২০ এমএমসিএফডি, সেখানে ১৫০এমএমসিএফডি পর‌্যন্ত উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত উত্তোলনের কারণে প্রথমে পানি পরে বালি আসতে থাকে। তারপরও বিষয়টিতে মনযোগ না দেওয়ায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় সাঙ্গু। বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ডও এক সময় বসে যেতে ধরেছিল।

তিনি বলেন, নিকট অতিতে এতো কিছুর পরও কোনই শিক্ষা গ্রহণ করেনি পেট্রোবাংলা। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস রিজার্ভ বিবিয়ানা। বর্তমানে দৈনিক উত্তোলিত গ্যাসের মধ্যে ৪৭.৫ শতাংশ (২৩ মে ২০২১) গ্যাস আসছে এই ফিল্ড থেকে। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন এই ফিল্ড থেকে অনেকদিন ধরে অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করছে। এতে গ্যাসের চাপ কমে এসেছে, সাঙ্গুর মতো বিবিয়ানাতেও পানি আসা শুরু করেছে। যে কোনো সময় ফিল্ডটির গ্যাস উৎপাদন ব্যাপক আকারে কমে যেতে পারে। কি হারে হ্রাস পাবে তা ধারনাতীত হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

শেভরন অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ ছাড়তে চায়, বছর তিনেক আগে চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে চলে যেতে চেযেছিল। গ্যাস ফিল্ড বন্ধ হয়ে গেলে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু বাংলাদেশের বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন সালেক সূফী।

তিনি বলেন, একই অবস্থা বাঙ্গুরা গ্যাস ফিল্ডেরও। এখানেও অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে গ্যাসের সঙ্গে পানি আসা শুরু হয়েছে। এই ফিল্ডটিও ঝূঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকারের উচিত হবে ফিল্ডগুলোর উপর স্ট্যাডি করে পরিকল্পনা নেওয়া। কূপের চাপ, রিজার্ভ ও চাহিদা রিভিউ করে পরিকল্পনা করা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত উৎপাদন করে তাদের মুনাফা দ্রুত তুলে নিতে চায়। কারণ যতো বেশি গ্যাস তুলবে ততো দ্রুত তাদের বিনিয়োগ উঠে আসবে।

তিনি বলেন, এখনই গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। এক সময় ২৭০০ এমএমসিএফডি পর‌্যন্ত উৎপাদন হয়েছে। এখন ২৫০০ এমএমসিএফডির নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদন বড় ধরণের হ্রাস পেতে পারে। তেমন পরিস্থিতির জন্য পেট্রোবাংলার কোনো প্রস্তুতি ‍দৃশ্যমান নয়। তারা এখনই গ্যাসের যোগান দিতে পারছে না। এলএনজি আমদানি করেও ঘাটতি সামাল দিতে পারছে না। গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত গতিতে, সেখানে যদি দেশীয় গ্যাস হ্রাস পায় তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। বর্তমানে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মোকাবেলা করার চেষ্টা চলছে। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়ানো বিষয়টিও সময় সাপেক্ষ এবং ব্যায় বহুল।

বর্তমানে ১০০০এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জণ করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে আর ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়, ২০১৮ সালের আগস্টে প্রথম ইউনিট ৫০০ এমএমসিএফডি আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ইউনিট এসেছে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। মাতারবাড়িতে ১০০০ এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। মাত্র কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নির্ধারিত সময়ে আসবে সে কথা বলা জটিল। পূর্বের অভিজ্ঞতা নেগেটিভ উত্তর দেয়। অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির ‍পথ প্রায় বন্ধ।

অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে ২০২৩ সালের দিকে গ্যাসের সম্ভাব্য উৎপাদন হ্রাস মোকাবেলায় কি পরিকল্পনা রয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আইয়ুব খান চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, এ বিষয়ে পরিচালক (অপরেশন এন্ড মাইনস) ভালো বলতে পারবেন। তার সঙ্গে কথা বলেন।

পরিচালক (অপরেশন এন্ড মাইনস) প্রকৌশলী আলী মোঃ আল মামুন  বার্তা২৪.কমকে বলেন, পিএসসির (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) মতামত নিয়েই অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। যে পরিমাণ বাড়তি উৎপাদনে টেকনিক্যালি সমস্যা হওয়ার কথা না সেই পরিমাণ তোলা হচ্ছে, এতে সমস্যা হওয়ার কথা না। ২০২৩ সাল নাগাদ উৎপাদন হ্রাস মোকাবেলায় কি উদ্যোগ রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি নতুন এসেছি, এ বিষয়ে ভালো করে না জেনে মন্তব্য করতে চাই না।

বাংলাদেশে এখন পর্য‌ন্ত ২৭টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরও ৭ টিএসএফ’র মতো। আর প্রতি বছরে উত্তোলিত হচ্ছে প্রায় ১ টিসিএফ’র মতো।

গ্যাসের ঘাটতি কারণে এখনই হিমশিম খেতে হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। গ্যাসের সরবরাহ কমে গেলে, বিদ্যুতের উৎপাদন কমে গিয়ে বেড়ে যেতে পারে লোডশেডিং। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের এমন শঙ্কা সঠিক হলে সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গলার কাঁটায় পরিণত হতে পারে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন এক সেমিনারে বলেছেন, আমাদের গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১১ হাজার মেগাওয়ার্ট। এসব কেন্দ্রে ১৫শ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি ১২শ এমএমসিএফডি (আগস্ট ২০২০)। যা দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারি। প্রায় ২৫ শতাংশ গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকছে। গ্যাস থেকে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮২৫০ মেগাওয়াটের মতো।

গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারতো কয়লা উত্তোলন ও বেশি বেশি কূপ খনন করা। কিন্তু সেই ট্রেন মিস করেছে বলে মনে করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কয়লা এখনই না তোলার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। আর বেশি কূপ খনন থেকেও রয়েছে অনেকটা পিছিয়ে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধ্যানও হতাশাজনক। জ্বালানি বিভাগের যখন বেহাল অবস্থা, তখন বিদ্যুৎ বিভাগ নতুন নতুন গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। ২০১৬ সালের রিভাইস মাস্টারপ্লান অনুযায়ী ২০২১ সালে ২৬৬১ মেগাওয়াট ও ২০২২ সালে ১১৮৮ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হওয়ার কথা।

মতামত নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেও বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নি। ফোন করলেও রিভিস করেন নি। অন্যদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আনিসুর রহমানকে প্রথমে ফোন করে পরে এসএমএস দিলেও সাড়া দেন নি।