বঙ্গোপসাগরে ১০৩ টিসিএফ গ্যাস-হাইড্রেট মজুদ!

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সিসমিক সার্ভের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস-হাইড্রেট প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। এ জন্য আরও সিসমিক সার্ভে পরিচালনার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

বুধবার (৫ জানুয়ারি) এক প্রেস বিফ্রিংয়ে সমীক্ষার বরাত দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন তথ্য জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ। এতোদিন প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে ৩ টিসিএফ আর সম্ভাব্য মজুদ বিবেচনা করা হয় আরও ৭ টিসিএফ।

সে দিক থেকে গ্যাস-হাইডেট্রের এই সম্ভাব্য মজুদ বিশাল সম্ভাবনার। হতাশার কথা হচ্ছে গ্যাস-হাইড্রেট পৃথিবীতে কোথাও উত্তোলন করার নজির নেই। জাপান প্রায় ৩০ বছর আর প্রতিবেশী দেশ ভারত ১৫ বছর ধরে উত্তোলন নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে, তবে এখনও সফলতার মুখ দেখেনি।

বিজ্ঞাপন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট এর উপস্থিতি, অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুদ নির্ণয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পূর্বে সম্পাদিত বিভিন্ন জরিপসমূহ হতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতরের অভিজ্ঞ প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়াল এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে একটি ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল। পরিপূর্ণ ধারণা পেতে আমাদের সম্পূর্ণ সমুদ্রাঞ্চলে সিসমিক জরিপের প্রয়োজন ছিল যা অনেক ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তাই আমরা ইতিমধ্যে সম্পন্নকৃত সিসমিক জরিপের ওপর ভিত্তি করেই এই ডেস্কটপ স্টাডি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ২০০৭-২০০৮ সালে বঙ্গোপসাগরে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৫০০ লাইন কি. মি. এবং ২০১০ সালে একটি ডাচ প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রায় ৩ হাজার লাইন কি. মি. সিসমিক ও ব্যাথিম্যাট্রিক জরিপ সম্পন্ন করে। এ জরিপসমূহের মাধ্যমে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের ভিতরে মহীসোপানে ৬ হাজার ৫’শ লাইন কি. মি. পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চলে বিদ্যমান সম্পদ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে যা বাপেক্স, পেট্রোবাংলা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটে সংরক্ষিত রয়েছে। এ সকল জরিপের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই ডেস্কটপ স্টাডিটি পরিচালনা করা হয়।

ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ গঠনের পর যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে অবস্থিত ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারসহ পেট্রোবাংলা, বাপেক্স এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞগণের যৌথ প্রয়াসে বিগত ৩ বছর ধরে সম্পন্ন করা হয়।

গ্যাস হাইড্রেট তথা মিথেন গ্যাস মূলত, উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফ আকৃতির এক ধরনের কঠিন পদার্থ যা স্তূপীকৃত বালির ছিদ্রের ভেতরে ছড়ানো স্ফটিক (ice) আকারে অথবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিন্ড, শীট বা রেখা আকারে বিদ্যমান থাকে। মহীসোপানের প্রান্তসীমায় (Continental Margin) ৩০০ মিটারের অধিক গভীরতায় সমুদ্রের তলদেশের নীচে গ্যাস হাইড্রেট পানি ও মাটির চাপে মিথেন বা স্ফটিক (ice) রূপে বিরাজ করতে দেখা যায় যা সাধারণত ৫০০ মিটার গভীরতায় স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে।

বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে বিশেষ করে ভারতের কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিনে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের মজুদের সম্ভাবনা বিষয়ে ভারত ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিন এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ১-২ বিলিয়ন টন মিশ্রিত তলানি জমা হয়। ভারত ইতিমধ্যে কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিনে এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে তিনটি স্থানে কূপ খনন করেছে। মহানন্দা বেসিনে সাগরের তলদেশে ২০৫ মিটার নীচে ২৫ মিটার পুরু একটি স্তরে প্রায় ১৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে।

ইতিপূর্বে সম্পাদিত জরিপ এলাকার ৬৫০০ কি. মি. লাইন সীমানার তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এই স্টাডি পরিচালিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে বাংলাদেশের ইইজেডের উল্লেখযোগ্য এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি ও মজুদের সমূহ সম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলনের প্রযুক্তি (Technology) সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক উন্নত দেশ এখনও গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলন শুরু করতে পারেনি। আমরা আশা করছি যে, অচিরেই এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হবে এবং আমরা বিভিন্ন উন্নত দেশের কাছ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব ।

আমাদের স্টাডি হতে প্রাপ্ত ফলাফল পূর্ণাঙ্গা সিসমিক জরিপ সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত মজুদের পরিমাণ ও উপস্থিতি নির্ণয় এবং পরিবেশগত প্রভাব ও তা প্রশমনের কৌশল নির্ণয়ের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রেরণ করা হবে ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই এই স্টাডির ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক ছিলেন এবং সকল ধরনের সমর্থন দিয়ে গেছেন। নিঃসন্দেহে, এই স্টাডি হতে প্রাপ্ত ফলাফল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আমরা আশা করছি অতিদ্রুত এই গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জ্বালানি ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করবে।