পথ হারিয়ে চোরাগলিতে দেশের গ্যাস সেক্টর
পথ হারিয়ে অন্ধকারের চোরাগলিতে হাবুডুবু করছে দেশের জ্বালানি খাত। যখন সহসা দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ কম, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চদর চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
গ্যাসের যোগান নিশ্চিত করতে হলে এই মুহূর্তে আমদানির বিকল্প নেই। আবার উচ্চমূল্যে আমদানি করে বর্তমান বাজারমূল্যে বিক্রি করা কঠিন। করোনায় নাকাল অর্থনীতির মধ্যেই দাম বাড়াতে উঠেপড়ে লেগে গেছে পেট্রোবাংলা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দাখিল করেছে সংস্থাটি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে আমদানিকরা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রয়মূল্য না বাড়ালে বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে। যে কারণে গ্যাসের দর গড়ে ১১৭ শতাংশ বাড়ানো দরকার।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য পড়ছে ১.২৬ টাকা,বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন থেকে ২.৮৯ টাকা, তাল্লো থেকে ৩.১০ টাকা করে দরে কেনা হচ্ছে। অন্যদিকে এলএনজির প্রকৃত ক্রয়মূল্য ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে। দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি বিবেচনায় এই দর। যদিও পেট্রোবাংলার এই হিসেবের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কেউ কেউ মনে করছেন দাম বাড়ানো যুক্তি দাঁড় করাতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হিসেব দেখানো হচ্ছে।
গ্যাসের বর্তমান সংকট সামাল দিতে যখন জ্বালানি বিভাগের নাকাল অবস্থা। বর্তমানের চাহিদাই গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না, প্রতিদিনেই রেশনিং করতে হচ্ছে, তারপরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সংকট সামাল দিতে গিয়ে অনেক গ্যাস ফিল্ড থেকে অত্যন্ত ঝূুঁকিপূর্ণভাবে বাড়তি গ্যাস উৎপাদন করার পথ বেছে নিতে হয়েছে। যা ওই গ্যাস ফিল্ডের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। নাকাল পরিস্থিতির মধ্যেই আরও খারাপ সংবাদ হচ্ছে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এক সময় ২৭০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে। এখন ২৫০০ এমএমসিএফডির নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদনে বড় ধরনের ধ্বংস নামতে পারে। বাংলাদেশে ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ ধারণা করা হয়। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরও ৭ টিএসএফ’র মতো। প্রতি বছর প্রায় ১ টিসিএফ’র মতো গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। এতে করে প্রমাণিত মজুদ ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে দ্রুত শিল্পায়ন ও ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কারণে গ্যাসের চাহিদাও প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে। আর ঘাটতি মোকাবিলা করতে এলএনজি আমদানির কথা বলা হয়েছে চলতি বাজেটে।
আমদানিকে যেভাবে সামনে আনা হয়েছে বাস্তবতা মোটেই অনুকূলে নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) ১০০০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে আরও ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়, ২০১৮ সালের আগস্টে প্রথম ইউনিট ৫০০ এমএমসিএফডি আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ইউনিট এসেছে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। সাগর উত্তাল হলেই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। এলএনজি আমদানি বাড়াতে মাতারবাড়িতে ১০০০ এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা।সম্প্রতি কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নির্ধারিত সময়ে আসবে সে কথা বলা জটিল। অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির পথ প্রায় বন্ধ। এরসঙ্গে রয়েছে অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার দরের ইস্যু। স্পর্ট মার্কেট থেকে মাত্র ৫-৬ শতাংশ এলএনজি আমদানি করায় সামাল দিতে পুরো গ্যাসে ১১৭ শতাংশ দাম বাড়াতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেলে বাজারদর কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলাই বাহুল্য।
গ্যাসের বর্তমান সংকট সামাল দিলে বিপদজনক পথে হাটছে পেট্রোবাংলা। অতিরিক্ত উৎপাদন গ্যাস ফিল্ডগুলোর মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আন্তর্জাতিক জালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, বাংলাদেশের কূপগুলোর গ্যাস উত্তোলনের ক্যাপাসিটি রয়েছে প্রায় ৩০ এমএমসিএফডির মতো। কিন্তু কিছু কূপ থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত উত্তোলন করা হচ্ছে। বিষয়টি গ্যাস ফিল্ডের জন্য ভয়ানক হতে পারে। বাংলাদেশের সাঙ্গু গ্যাস ফিল্ড এভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সাঙ্গুর উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১২০ এমএমসিএফডি, সেখানে ১৫০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত উত্তোলনের কারণে প্রথমে পানি পরে বালি আসতে থাকে। তারপরও বিষয়টিতে মনযোগ না দেওয়ায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় সাঙ্গু। তারপরও আমরা শিক্ষা নেই নি।
আজকের এই সংকটের মূলে রয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েক দশকের স্থবিরতা। যার পুঞ্জিভূত ফল আজকের এই মহাসংকট। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৪০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, একই সময়ে ত্রিপুরা তার স্বল্প আয়তনে কূপ খনন করেছে ১৬০টি। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে মাত্র ১১টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ গত ১১০ বছরে মাত্র ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই রয়ে গেছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারেই তা মেনে চলেনি। বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করলেও সেখানে কোনো কাজ করা যায়নি। সাগরে পিএসসি (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) আহ্বান করা হলে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিদেশি কোম্পানিগুলো। কোম্পানিগুলোর অভিযোগ ইতিপূর্বে সাগরে পরিচালিত সিচমিক সার্ভের তথ্য পেট্রোবাংলা তালাবদ্ধ করে রেখেছে। এগুলো না দেখতে পেলে খালি খালি কেউ জলে টাকা ঢালতে আসবে না। অতীতে এই তথ্য কেনার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও এখন রহস্যজনক কারণে তালাবদ্ধ করা হয়েছে। আর এ কারণেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা। আজকের গ্যাস সংকট তার সামগ্রিক ফল বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। আর পেট্রোবাংলার কর্তাদের অনুযোগ হচ্ছে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলো আসতে চাইছে না। যদিও পেট্রোবাংলার এই মতের সঙ্গে অনেকেই একমত নন। তারা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের চেয়ে ঢের বেশি তথ্য রয়েছে বাংলাদেশের হাতে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সার্ভে তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সাগরে ১০৩ টিসিএফ গ্যাসহাইড্রেট প্রাপ্তির সম্ভাবনার ঘোষণা করলে আরেকবার সমালোচনায় পড়েছে পেট্রোবাংলা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বঙ্গবন্ধু সরকার ছাড়া আরও কোনো সরকারেই এই দিকে যথেষ্ট মনযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের সময়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গতি ফিরলেও সমন্বয়ের অভাবে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাস সংকটে যখন নাকাল দেশ তখন ভোলায় কূপে গ্যাস নিয়ে বসে আছে বাপেক্স। এ জন্য জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় আরেকটি ভালো উপায় হতে পারতো দেশীয় কয়লার বিশাল মজুদ। কিন্তু সেই ট্রেন মিস করেছে কয়লা এখনই না তোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত।
জ্বালানি বিভাগের যখন বেহাল অবস্থা, তখন বিদ্যুৎ বিভাগ নতুন নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। ২০১৬ সালের রিভাইস মাস্টারপ্লান অনুযায়ী ২০২১ সালে ২৬৬১ মেগাওয়াট ও ২০২২ সালে ১১৮৮ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় চিন্তা করেছিলেন সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে শুধু কৃষি নির্ভর দিয়ে হবে না। শিল্পায়ন করতে হবে, শিল্পায়ন করতে হলে তেল-গ্যাস লাগবে। সে জন্য জ্বালানিটাকে নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তখন শেলওয়েলকে গ্যাস নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করার নির্দেশ দেন। শেলওয়েল বললো আমাদের যেসব লাইন রয়েছে, সেখানেই গ্রাহক পাচ্ছি না। লাইন বাড়ানোর সম্ভব না। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, পনেরো দিনের মধ্যে পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে আসবা, না হলে বিক্রি করার প্রস্তাব নিয়ে আসো। তখন শেল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ভেবে বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে আসে। এভাবে ৫টি গ্যাস ফিল্ডের মালিক হয়ে যায় বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, আমরা এখন যেভাবে আমদানি নির্ভরতার দিকে যাচ্ছি ২০৩০ সালে ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে জ্বালানি আমদানিতে। ফরেন রিজার্ভের সিংহভাগ যদি জ্বালানি ব্যয় করি তাহলে উন্নত দেশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই যাদের এই ফিলোসফিতে বিশ্বাস রয়েছে। তারা দয়া করে রাস্তাটা ছেড়ে দেন।
মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, এখন সমস্যা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু তিন দিনে যে সিদ্ধান্ত দিতেন, সেটি এখন ৩ মাসেও হয় না।