ভর্তুকি নাকি দাম বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতে ঘাটতি ৫২ হাজার কোটি টাকা!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির তোড়জোড় বেশ জোরেশোরেই চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে দাম না বাড়ালে তাদের প্রায় ৩০ হাজার ২’শ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে, আর গ্যাস সেক্টর বলছে দাম না বাড়ালে তাদের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে চলতি বছরে (২০২২ সালে)।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও পেট্রোবাংলা গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আবেদনের উপর গণশুনানির তারিখ ঘোষণা করেছে বিইআরসি। অন্যদিকে গ্যাসের দামের সঙ্গে যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ জড়িত তাই গ্যাসের বিষয়ে মিমাংসা করে বিদ্যুতের বিষয়ে গণশুনানিতে যেতে চায় রেগুলেটরি সংস্থা।

বিজ্ঞাপন

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভ্রান্ত নীতির কারণে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে, আর সে কারণেই দাম বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ভোক্তাদের দাবী করোনায় মানুষের নাকাল অবস্থা, তাই এই সময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোন ভাবেই সঠিক হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও গ্যাস বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর দাবী উঠেছে।

এমনি এক অবস্থায় মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ইস্যুটি আবার সামনে চলে এসেছে। অনেকেই মনে করছেন এবার মনে হয় দাম বাড়ানো বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। অতীতে কখনও কখনও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গেলে বিইআরসি ভর্তুকি দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দাম বাড়ানো থেকে বিরত থেকেছে। এবার হয়তো ওই পথটি আগে থেকেই রূদ্ধ হয়ে গেলো।

বিইআরসিতে দাখিলকৃত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়াতে হয়েছে। গত জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় খরচ ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরে শুধু জ্বালানি বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩ টাকা ১৬ পয়সা জ্বালানি খরচ হয়। আগের অর্থবছর ২০১৯-২০ এই ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিটে ২ টাকা ১৩ পয়সা। এদিকে গত জুলাইয়ে কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও কয়লার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব ধরনের জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং গ্যাস সরবরাহ আরও কমে যাওয়ায় চলতি ২০২২ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট জ্বালানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪ টাকা ২৪ পয়সা। আর জ্বালানি বাবদ মোট ব্যয় বাড়বে ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের তুলনায় তা তিন ভাগের এক ভাগের চেয়ে বেশি হবে। তবে সম্প্রতি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা কার্যকর হলে বিদ্যুতের জ্বালানি খরচ আরও বাড়বে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিইআরসি বিদ্যুতের গড় পাইকারি দাম নির্ধারণ করে ৫.১৭ টাকা। যদিও গত অর্থবছর গড় পাইকারি বিক্রয় মূল্য ৫.১২ টাকা নেমে যায়। ওই বছরে সব মিলিয়ে পিডিবির রাজস্ব আদায় করে ৩৯ হাজার ৫২ কোটি টাকা। একই সময়ে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এতে করে লোকসান হয় ১১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকার ১১ মাসের জন্য (জুলাই ২০২০-মে ২০২১) ভর্তুকি দিয়েছে ১০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ভর্তুকি এখনও অপেক্ষাধীন। চলতি ২০২২ সালে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো হলে ৩০ হাজার ২’শ কোটি টাকা ঘাটতি হবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা হয়েছে, দাম বাড়লে লোকসান আরও বেড়ে যাবে। তাই লোকসান সামাল দিতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি করার আবেদন করেছে বিপিডিবি।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলার জেনারেল ম্যানেজার (হিসাব) নজরুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। যে কারণে বর্তমানে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। গ্যাসের দাম না বাড়ালে চলতি বছরে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এই দাম বর্তমান দর বিবেচনায়, এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দর আরও বাড়ে তাহলে লোকসান আরও বেড়ে যাবে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই হাজার কোটি টাকা জ্বালানি বিভাগকে দিয়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে সরকারের এখনি দরকার ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গত নভেম্বরে অর্থ বিভাগের কাছে ৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার ভর্তুকি চেয়ে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। তখন অর্থ বিভাগ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় ভর্তূকি বাড়ানো সম্ভব না।

বিইআরসিতে দাখিলকৃত পেট্রোবাংলার চিঠিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য পড়ছে ১.২৬ টাকা, বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন থেকে ২.৮৯ টাকা, তাল্লো থেকে ৩.১০ টাকা করে দরে কেনা হচ্ছে। অন্যদিকে এলএনজির প্রকৃত ক্রয়মূল্য ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে।  এদিকে (২৩ ফেব্রুয়ারি) ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ২৯.৭০ ডলার (এমএমবিটিইউ) দরে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৪ কোটি ৬৯ লাখ ৮ হাজার টাকা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, জনগণকে বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে। সিস্টেমে থাকা ৫-৬ শতাংশের দাম বেড়েছে বলে পুরো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়াতে হয় এটা বিশ্বাসযোগ্য! তারা গোজামিল দিয়ে হিসেব দেখাচ্ছে, এসব হিসাব বাস্তব সম্মত না। প্রয়োজন হলে ওই পরিমাণ এলএনজি আমদানি না করার পক্ষে আমরা। তবুও দাম বাড়ানো উচিত হবে না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এই অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না।