গ্যাসে ভর্তুকি কমিয়ে ২০ ভাগ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ, তোপে টিইসি
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। আর এই অংক কষতে গিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস খাতে ভর্তুকি কমিয়ে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর প্রফিট মার্জিন ধরে হিসাব করায় বেজায় চটেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, আপনাদের করা আইন আপনারাই মানছেন না। আইনে স্পষ্ট রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি নো প্রফিট নো লোকসান পদ্ধতিতে চলবে। আপনারা কিসের ভিত্তিতে চাহিদার তুলনায় বেশি রাজস্ব দিতে চাচ্ছেন, অতীতেও দিয়েছেন। বিইআরসি চেয়ারম্যানও ক্যাবের এই মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, প্রফিট বিবেচনায় নেওয়া যাবে না।
পাশাপাশি ভর্তুকি কমিয়ে ক্যালকুলেট করা নিয়েও ক্যাবের তোপের মুখে পড়ে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)। চলতি অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা ভর্তুকির আদেশ ছিল বিইআরসির। কিন্তু এখন পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা ছাড় করা হয়েছে। আর এটাকে ভিত্তি ধরে আগামী বছরের হিসাব করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজনীতা দেখিয়েছে টিইসি। ক্যাবের জেরার মুখে টিইসি স্বীকার করেন, সরকার যেটুকু দিয়েছে সেটাই ধরে নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আর দেবে কি, দেবে না সে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ভর্তুকি পুরোপুরি থাকলে এতো দাম বাড়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। টিইসি এমন ভূমিকার জন্য কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) বিয়াম মিলনায়তনে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল) গ্যাসের বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিতে এমন তোপের মুখে পড়ে টিইসি।
ক্যাব বলেছে, করোনার সময় ভর্তুকি বাড়িয়ে ভোক্তাদের করুণা পাওয়ার কথা। সেখানে ভর্তুকি অর্ধেক ৩ হাজার কোটিতে নামিয়ে এনেছেন। এটি মোটেই সঠিক হয়নি। বিইআরসি ভর্তুকির যে আদেশ দিয়েছে সরকার তা বাতিল করেনি। তাহলে কেনো এই অবস্থান আমাদের। আপনারা কোম্পানিগুলোকে প্রফিট দিচ্ছেন, তারা কয়েকটা করে বোনাস নিচ্ছে, সরকারকে কোটি কোটি টাকা মুনাফা (ডিভিডেন্ট) দিচ্ছে। তারপরও টাকা জমে থাকছে সেখান থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে সরকার। আর বছর বছর ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। সমস্ত বিধিবিধান পুরোপুরি মেনে চললে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোন সুযোগ নেই এবং প্রয়োজনীয়তা পড়ে না। বরং কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ প্রত্যেকটি বিতরণ কোম্পানি মুনাফায় রয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে গ্যাস দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সময় গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ১২.৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই আদেশে সরকারকে ২.৯০ টাকা ভর্তুকি দিতে বলা হয়। সরকার ওই ভর্তুকি বাবদ ছাড় করেছে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা, আর পেট্রোবাংলা এনার্জি নিরাপত্তা তহবিল থেকে দিয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। এটাকেই ভিত্তি ধরে আগামী বছরে প্রাক্কলন করায় প্রবল আপত্তি দিয়েছে ক্যাব।
গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো আকাশচুম্বি ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির আবেদন করেছে। কিন্তু গণশুনানিতে তারা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ৯৯ এমএমসিএফডি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়াকে তুলে এনেছে পেট্রোবাংলা। কিন্তু ভোক্তারা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছে, দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন বাড়িয়ে সংকট মোকাবিল করা যায়, আবার সিস্টেম লসের নামে চুরি ঠেকিয়েও সম্ভব। একইসঙ্গে বর্তমানের অস্বাভাবিক দরকে ভিত্তি ধরে বিবেচনা করা মোটেই যৌক্তিক হবে না।
মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো গণশুনানিতে গ্রহণ করা হয়। এদিন সকালে ভোলা ও খুলনা অঞ্চলের বিতরণের দায়িত্বে থাকা সুন্দরবন কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। ওই কোম্পানিটিও তার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়।
বিকেলে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। কোম্পানিটি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিতরণ মাশুল ২৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৬ পয়সা করার আবেদন করেছে। তবে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি মনে করছে তাদের বিতরণ মাশুল না দিলেও .০৭ পয়সা হারে প্রফিট হবে। তাই দাম না বাড়িয়ে বিদ্যমান ২৬ পয়সা বিতরণ চার্জ বিলোপ করা যায়।
পিজিসিএল'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মান্নান পাটওয়ারী বলেন, আমরা চাহিদা মতো গ্যাস পাই না, কখনও কারিগরি ত্রুটির কারণে চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ সম্ভব হয় না। যে কারণে রাজস্ব আদায় কম হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে প্রতিবছর গ্যাস সরবরাহ কমে যাচ্ছে। যথাক্রমে পরের বছর ৯.০৬ শতাংশ, তার পরের বছর ২৯.৭৬ শতাংশ কমে গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৮.৭৬ শতাংশ কমে যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে করে মুনাফা কমে যাচ্ছে, এফডিআর ভেঙে খরচ মেটাতে হচ্ছে। আমাদের তহবিল ক্রাইসিস ব্যাপক।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, দেশের উন্নয়ন আমরা সকলে চাই। সেবাটা নিশ্চিত করুন, ভোক্তারা আপনার মাথায় তেল দেবে। সেবা নিশ্চিত করলে দেশের ও জনগণের উন্নতি হবে। আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। ক্রাইসিস মিট করার জন্য ভোক্তার ওপর চাপ না বাড়িয়ে কি করা যায় সবার ভাবা উচিত। আমরা যথাযথ তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত জানাবো। হুমজিক্যালি কোন সিদ্ধান্ত দেবে না বিইআরসি। প্রয়োজন হলে তাদের জমানো টাকা খরচ করার বিষয়েও আমরা চিন্তা ভাবনা করছি।
তিনি আরও বলেন, দাম বৃদ্ধি হলে সামাজিক প্রভাব কি হবে সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। কোম্পানিগুলোর সমীক্ষা থাকা উচিত ছিল। তারা বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। এমনকি টেকনিক্যাল কমিটিও যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি প্রিপেইড মিটার স্থাপনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। বলেন, আগামী আদেশে আমরা বিষয়টি সামনে আনতে চাই।