গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব তাদের আগ্রহে হয়নি, বাখরাবাদের স্বীকারোক্তি

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

গ্যাসের আকাশচুম্বি দামের বিষয়ে কোনো যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারেনি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং বাখরাবাদ গ্যাস ডিট্রিবিউশন কোম্পানি। তৃতীয় দিনের মতো চলা গণশুনানিতে অংশ নিয়ে চরম তোপের মুখে পড়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুই কোম্পানির শীর্ষ কর্তারা।

ক্যাবের জেরার মুখে দুই কোম্পানির শীর্ষ কর্তারা শেষপর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন- পেট্রোবাংলা বলেছে, সে কারণে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা এখন মুনাফায় রয়েছে। বিদ্যমান অবস্থায় দাম বাড়ানোর বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে দাবি নেই। নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন, সে কারণে বিতরণ চার্জ বাড়ানো প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

কোম্পানি দুটি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ডিভিডেন্ট দিতে গিয়ে তাদের সংকট তৈরি হচ্ছে। আবার কয়েক দফায় ট্যাক্স নিয়েও বিপাকে রয়েছেন। আবার সময়ে সময়ে পেট্রোবাংলার অনেক আদেশ কোম্পানির স্বার্থে হচ্ছে না। তারপরও তারা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

বুধবার (২৩ মার্চ) বিয়াম মিলনায়তনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত শুনানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন শ্রেণির ভোক্তারা। কোম্পানি দুটি ভোক্তাপর্যায়ে ১১৭ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এটি যাচাই বাছাই করে গড়ে ২০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

বিজ্ঞাপন

দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, তিতাসের কাছ থেকে রাজস্ব ও লভ্যংশ হিসেবে শত শত কোটি টাকা নিচ্ছে সরকার। অথচ এর উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে না। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তারা, যা অযৌক্তিক।

এসময় অবৈধ সংযোগের হিসাব চাইলে তা দিতে পারেনি তিতাস। এর জন্য গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা চাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, সরকার মুনাফা নিচ্ছে, দায় নিচ্ছে না। যথাযথ আইন মানা হলে গ্যাসের দাম বাড়ার পরিবর্তে আরও কমবে। তাই দাম অপরিবর্তিত রেখে উদ্ধৃত আয় বিইআরসির হিসাবে নেওয়ার দাবি জানান তিনি। গ্যাসের মূল্য স্থিতিশীল রাখার একটি তহবিল গঠনেরও দাবি জানান তিনি।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, তিতাসের ৫৪ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে শিল্প খাত। চাহিদা মতো গ্যাস না পেয়েও সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দিয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতকে ধ্বংস করার দিকে না নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সিরামিকস রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে গোলাম সারোয়ার বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় শত শত কোটি টাকার যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগে সেবা নিশ্চিত করেন, তারপর বাড়তি দাম চান। আর না হলে শিল্প ধসে যাবে।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, হাজার হাজার, লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ আছে। এগুলো কাটার পর আবার লাগাচ্ছে। লোকবল কম থাকায় এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারা যাচ্ছে না। বকেয়া বিল আদায় করতে হিমশিম খেতে হয়। বদনামের জন্য কাজ করা যাচ্ছে না। মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ কর্মী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। গ্রাহকদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের একার পক্ষে সম্ভব না অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা।

আরও কয়েকজন ভোক্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অবৈধ সংযোগের নামে শত শত কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। সিস্টেম লসের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হচ্ছে। অথচ এসব বিষয়ে তিতাস কিছুই করতে পারছে না। তিতাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

এক ভোক্তা জানতে চান, প্রিপ্রেইড মিটার গ্রাহকেরা মাসে গড়ে কত টাকা বিল দেন। এর উত্তরে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। ওই ভোক্তা তখন বলেন, মিটার আছে মাত্র তিন লাখ গ্রাহকের। এর বাইরে থাকা লাখ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে মাসে প্রায় ৪০০ টাকা করে বাড়তি নিয়েছে তিতাস। অতীতে বাড়তি নেওয়া এসব টাকার সুরাহার দায়িত্ব নেওয়া উচিত কমিশনের।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা ঋণ করে নাকি সরকারের তহবিল থেকে আসবে সেটা দেখার বিষয় আছে। সাধারণত, মানুষ দুর্যোগে পড়লে শেষ সঞ্চয় ব্যবহার করে। গ্যাস খাতের সব সংস্থার কাছে ১২ হাজার কোটি টাকা জমা আছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। আবার বিতরণ কোম্পানির মালিক সরকার, তারা কেনো প্রস্তাব এনেছে সরকারের সিদ্ধান্ত কিনা, তাদের সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিকতা নিশ্চিত করেই কমিশন আদেশ দেবে। হুমজিক্যালি কোন সিদ্ধান্ত দেবে না কমিশন।

বিকেলে গ্যাসের কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস বিতরণ কোম্পানি বাখরাবাদের প্রস্তাবের উপর শুনানি হয়। কোম্পানিটি গ্যাসের দাম ‍বৃদ্ধির পাশাপাশি তাতের বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৮ পয়সা করার আবেদন করে। তবে কারিগরি কমিটি তাদের বিদ্যমান বিতরণ চার্জও বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছে। বিতরণ চার্জ বাতিলের সুপারিশ করে বলেছে, বিতরণ চার্জ না থাকলেও মুনাফায় থাকবে কোম্পানি।

শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য মকবুল ই ইলাহি চৌধুরী, মোহাম্মদ আবু ফারুক, মোহাম্মদ বজলুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান। বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে গণশুনানি পর্ব। শুনানি পরবর্তী লিখিত মতামত দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে ৭ এপ্রিল পর‌্যন্ত। এরপর প্রস্তাব ও মতামত যাচাই করে আগামী ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার বিধান রযেছে।

কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুসারে তিতাসের আবাসিক গ্রাহকদের দুই চুলায় গ্যাসের বিল বাড়বে ১০৫ টাকা। মাসে ৯৭৫ থেকে নতুন বিল হবে এক হাজার ৮০ টাকা। আর এক চুলায় গ্যাসের বিল বাড়বে ৬৫ টাকা। ৯২৫ থেকে বেড়ে এক চুলার বিল হবে ৯৯০ টাকা।

গ্যাস দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে পেট্রোবাংলা বলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে তাই দাম বাড়াতে হচ্ছে। তবে ভোক্তারা বলেছে, মাত্র ৩ শতাংশ গ্যাস স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা হয়েছে। সেই গ্যাসের দাম বেড়েছে বলে ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ অযৌক্তিক।