বিতরণ চার্জ বাড়াতে এসে হারানোর শঙ্কায় গ্যাস কোম্পানিগুলো

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পেট্রোবাংলা, জিটিসিএল এবং ৬টি বিতরণ কোম্পানি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি শেষ হয়েছে। কোম্পানিগুলো ভিন্ন ভিন্ন মাশুল(কমিশন)দাবী করলেও গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধির আবেদন করে।

তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের(বিইআরসি)কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গ্রাহক পর‌্যাযে ২০ শতাংশ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সুপারিশ, আর বিতরণ মাশুল বৃদ্ধির পরিবর্তে তাদের বিদ্যমান মাশুল বাতিলের সুপারিশ করেছে। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানির কর্নফূলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কিছুটা মাশুল দেওয়ার মতামত দিয়েছে। তবে বর্তমান দর ঘনমিটার ২৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ৯ পয়সা করার সুপারিশ এসেছে। অন্যদিকে একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল বর্তমান চার্জ ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯৭ টাকা করার প্রস্তাব দিলেও মাত্র ৬ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ এসেছে।

বিজ্ঞাপন

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের চড়া মূল্যের কথা বলেছে পেট্রোবাংলা। আর বিতরণ কোম্পানিগুলো সকলেই বলেছে তাদের নতুন নতুন প্রকল্প নিতে হচ্ছে এতে অর্থের প্রয়োজন পড়ছে। যে কারণে মাশুল বাড়িয়ে সেই টাকার সংস্থান করার আবেদন করেছে। কোম্পানিগুলো বলেছে, পেট্রোবাংলা তাদের উপর অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের অগ্রিম আয়কর পরে সমন্বয় করার কথা থাকলেও এনবিআর ফেরত দিচ্ছে না। আবার অর্থ মন্ত্রণালয় শেয়ারের বিপরীতে প্রদত্ত ডিভিডেন্ডের অংকও চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে দিনে দিনে কোম্পানিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে।

ক্যাব, ভোক্তাদের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী নেতা ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ গ্যাসের দাম ‍বৃদ্ধির প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেন। তারা দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে বলেন, করোনা পরবর্তী মানুষের যখন ত্রাহী অবস্থা এমন সময়ে ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক।ভোক্তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা একমত পোষন করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল।তিনি সমাপনী বক্তব্যে বলেন, পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাবটি দিয়েছে যৌক্তিকতা, ন্যায্যতা ও বাস্তবতার নিরিখে সন্তোষজনক নয়। যদি দেখি দাম বৃদ্ধির কোন বিকল্প রয়েছে তাহলে সেটাই গ্রহণ করা হবে।

চেয়ারম্যান বলেন, প্রস্তাবটি ন্যায্য ও যৌক্তিক পযায়ে নেওয়ার জন্য পোস্ট শুনানিতে বিশ্লেষন করা হবে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। যদি দেখি দেশীয় ও আন্তজাতিকভাবে কোন বিকল্প রয়েছে তাহলে সেটা গ্রহণ করা হবে। যদি দেখি কোন বিকল্প নেই তখন যেটুকু না বাড়ালে নয়, যাতে ভোক্তার কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।


প্রি-পেইড মিটার স্থাপন বিলম্বিত হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, একটি কথা প্রমাণিত হয়েছে আবাসিক গ্রাহকরা মাসিক ভিত্তিতে ৭৮ ঘনমিটারের যে বিল দিচ্ছে সেই পরিমাণ গ্যাস তারা পুড়ছে না। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন যতো দ্রুত সম্ভব করা উচিত। বিতরণ কোম্পানিগুলো যে ভাবে কাজ করছে তাতে অনেক বছর লেগে যাবে। সরকার নীতিমালা করে দিয়েছে খোলা মাকেট থেকে কেনার জন্য। আল্লাহর ওয়াস্তে উন্মুক্ত করে দেন, গ্রাহকরা নিজে কিনে নিবে।

এ সময় জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির এক কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে ব্যাখা দিতে চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, এটা টেকনিক্যালী খুব জটিল। এতে চেয়ারম্যান কিছুটা চড়া গলায় বলেন, আমাকে মহাভারত, ও হিমালয়ের চুড়া দেখাতে আসবেন না। আপনারা সিস্টেম ডেভেলপ করে দেন তারা কিনে বসিয়ে নিক। আপনারা নিজেরা বসালে ২২ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ছে। ভোক্তারা কিনতে ৪-৫ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়বে বলে মনে হয় না। আর আপনাদের বসানোর গতিও সন্তোষজনক নয়।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে ভোক্তাদের তোপের মুখে পড়ে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। কোনো প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর ও ব্যাখা দিতে ব্যার্থ হন। গোজামিল দিয়ে তথ্য উত্থাপন করতে খোদ বিইআরসির নানা ভৎসনার শিকার হন।বিশেষজ্ঞরা মনে করছে জ্বালানি বিভাগ সোজা পথে পরিচালিত না হয়ে ভুল পথে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাস সেক্টর সোজা পথে না গিয়ে ভুলপথে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দেশের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় অনুসন্ধ্যান করে গ্যাস নেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। সাগরের কথা বাদই দিলাম, আমাদের স্থলভাবে আরও অনেক গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য যথাযথভাবে অনুসন্ধান কার‌্যক্রম করা দরকার। যা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই করতে ব্যর্থ হয়েছি। যার ফলে আজকে উচ্চদরে এলএনজি আমদানির ইস্যু চলে এসেছে। যথাযথভাবে অনুসন্ধান কার‌্যক্রম পরিচালিত হলে আজকে এই সংকট তৈরি হতো না। অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেওয়া না গেলে এভাবে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব আসবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি অনুসন্ধান এবং পুরনো পরিত্যাক্ত কূপগুলো ওয়ার্কওভার করা যায়। একটি একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে ওয়ার্কওভার করে ৩ থেকে ৪’শ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আমার মনে হয় সঠিক দিকে দৃষ্টিপাত করি। না হলে সমস্যা নির্মুল করা সম্ভব হবে না।

কারিগরি কমিটি তাদের রিপোর্টে দেখিয়েছেন স্পট মাকেট থেকে দৈনিক ৯৯.৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। যা মোট গ্যাসের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশের মতো। আর এটা নিয়েই যতো আপত্তি জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন অন্যান্য উৎসের গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত তখন শুধু স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ৩শতাংশ গ্যাসের দাম বেড়েছে জন্য অবিশ্বাস্য দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ভোক্তারা এই মুহুতে দাম না বাড়ানোর পক্ষে মতামত দিয়েছে। সবশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে (২০১৯ সালে) পাইকারি দর প্রতি ঘনমিটার ১২.৬০ টাকা করা হয়। এরমধ্যে ভর্তুকি দিয়ে ৯.৭০ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেয় বিইআরসি।

অন্যদিকে চলতি অর্থ বছরে সেই ভর্তুকির মধ্যে অর্ধেক পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। আর ভর্তুকি দেবে না এটা ধরেই গ্যাসের দর নির্ধারণ পথে এগিয়েছে কারিগরি কমিটি। এতে ক্যাবের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয়। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, সরকার আর দেবে না এ কথা বলেনি। তাহলে কেনো আমরা ধরে নিচ্ছি। করোনা কালে সরকারতো আরও বেশি দেওয়ার কথা। উল্টো কমাবে এটা হতেই পারে না। অবশ্যই তাকে ভর্তুকি দিতে হবে।

কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে শুনানি নেন কমিশনের সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী, বজলুর রহমান, মোহাম্মদ আবু ফারুক ও মোঃ কামরুজ্জামান। টানা চতুর্থ দিনের গণশুনানির মাধ্যমে শেষ হয়। আগামী ৭ এপ্রিলের মধ্যে শুনারি পরিবর্তী সম্পুরক তথ্য ও লিখিত দেওয়া যাবে। এরপর ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিধান রয়েছে।

বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, অডিট রিপোর্টে সবার মার্জিন দেখা গেছে, তাহলে কেনো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা দিবেন। জিডিএফ জনগণের পয়সা দ্বারা গঠিত, এখান থেকে ৩হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে সরকার। সে বিষয়ে পেট্রোবাংলার সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সিস্টেম লস সাড়ে ৮ শতাংশের উপরে। পৃথিবীর কোথাও ২ শতাংশের বেশি নেই।সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য মাত্রায় হওয়া উচিত। কোম্পানিগুলো তার তথ্যের প্রতি দৃঢ় এবং অবিচল নয়। তার আজকে একটি তথ্য দিলে কয়েকদিন পরে আরেক রকম তথ্য দিচ্ছে।