খরচ সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখছে বিপিডিবি!
ঢাকাঃ যেখানে গ্যাস সরবরাহ করলে তুলনামূলক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো, সেই কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হচ্ছে। তুলনামূলক কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তেমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তও এক্ষেত্রে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টে যেহেতু কম জ্বালানিতে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তাই এগুলো প্রথম চালু করা হবে। এরপর যদি ঘাটতি থাকে তাহলে ধাপে ধাপে ব্যায়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা হবে।
গত ৯ মে তারিখের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২৫টি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৮টি পুরোপুরি চালানো হয়েছে। আর ১০টিতে আংশিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে গ্যাস ঘাটতির কারণে। অপর ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোনটি যান্ত্রিক ত্রুটি অথবা নিয়মিত মেরামতের কারণে হয় আংশিক উৎপাদন করেছে নয়তো পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২৫টি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ৭ হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট। ওই দিন ৫৭৮ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করে মাত্র ৪ হাজার ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা সচল রাখতে মোট গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে ১ হাজার ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বরাবরেই ১১শ’ এমএমসিএফডির বেশি গ্যাস সরবরাহ পেয়ে এসেছে। ২০২১ সালে জুন মাসে গড়ে ১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবারের তথ্য পাওয়া গেছে।
৯ মে তারিখে গ্যাস ঘাটতির কারণে আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে (পিক আওয়ার) উৎপাদন করেছে মাত্র ৩৫ মেগাওয়াট। একই ক্ষমতাসম্পন্ন আশুগঞ্জের আরেকটি ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩০২ মেগাওয়াট, ভেড়ারামা ৪১০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন করা হয়েছে ১৮০ মেগাওয়াট। কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র না চালিয়ে সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহকে অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে গ্যাস দিয়ে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি পাওয়া সম্ভব। এসব হিসেব জানার পরও কেনো বিপিডিবি সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করছে তার কারণ খুজে পাচ্ছেন না কেউই।
বিপিডিবির জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, কম্বাইন্ড সাইকেল বসিয়ে রেখে সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর কোন সুযোগ নেই। মেরিট অর্ডার অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করা হয়। যেখানে উৎপাদন খরচ কম সেখান থেকে শুরু করা হয়। ধাপে ধাপে উপরদিকে যাওয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল কারণে কিছু তারতম্য ঘটতে পারে। উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে দূর থেকে বিদ্যুৎ না নিয়ে ওই অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি চালাতে হয়।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্ট অধ্যাপক ড. শামসুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, তারা যেসব কথা বলে, এসব কথাবার্তা বাস্তবতার সঙ্গে প্রমাণ পাওয়া যায় না। যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপরেশনের বাইরে রয়েছে, সেগুলো কারণসহ উল্লেখ থাকতে হবে, তারা সেটি করে না। আমাদের যেহেতু গ্যাস কমে আসছে, তাই আনুসাঙ্গিক খরচ বেশি হলেও যেখানে গ্যাস কম লাগবে সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো উচিত। বিডিপিবি তা করে না, তারা সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কম চালায় বেশি ব্যায় দেখাতে, আর আইপিপি (বেসরকারি) বেশি চালায় খরচ কম দেখাতে। সরকারি তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চালালে ইউনিট প্রতি খরচ পড়ে ২০ টাকা, আর আইপিপি ১৩ শতাংশ প্লান্ট ফ্যান্টরে চালালে খরচ পড়ে ৩১ টাকার মতো।
ড. শামসুল আলম বলেন, বিবিয়ানা দক্ষিণ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দশমিক ১৯ ঘনমিটার গ্যাসে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ভোলা আইপিপিসহ কোথাও দশমিক ২৪ ঘনমিটার ব্যবহার হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে কম্পাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। তাই কম্পাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আগে চালানো হয়।
৯ মে কেনো মাত্র অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করা হলো, এদিনতো অনেক বেশি সরবরাহ ছিল। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, হয়তো কোনো টেকনিক্যাল কারণ রয়েছে। অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে গ্যাস নেওয়া কঠিন, আবার গ্রিডের টেকনিক্যাল কারণের উপরও নির্ভরশীল কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগে চালানো হবে। হয়তো টেকনিক্যাল কোন কারণ থাকতে পারে। বিপিডিবির কাছে নিশ্চয় ব্যাখ্যা রয়েছে।
কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি সাইকেল থাকে, প্রথমত গ্যাস পুড়িয়ে টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি টারবাইন থেকে নির্গত তাপ ব্যবহার করে উত্তপ্ত পানির বাষ্প দিয়ে আরেকটি টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে টারবাইন থেকে নির্গত তাপ কোনো কাজে আসে না। অর্থাৎ কম্বাইন্ড সাইকেলে একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে দেড়গুণ বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
বিপিডিবির পরিকল্পনায় এসব ঘাটতি নিয়ে অনেকদিন ধরেই সমালোচনা চলছে। বলা হচ্ছে বিপিডিপির পরিকল্পায় ভুলের কারণে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। আগামী ১৮ মে আবার বিদ্যুৎ পাইকারি দাম বৃদ্ধি গণশুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে বিইআরসি।