বিপিডিবির অদক্ষতা ও অসমচুক্তির ফল বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) অদক্ষতা, লুটপাট ও অসম চুক্তির কারণে লাফিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ। উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানির মুনাফা লাফিয়ে বাড়লেও ডুবতে বসেছে বিপিডিবি।
অপরেশনে থাকা সরকারি ৫ বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির মুনাফা বেড়েই চলেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সচিব ও কাউন্সিল অফিসার মোঃ জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেখা গেছে, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির(নওপাজেকো) গত অর্থবছরের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা করেছে। কোম্পানিটি (২০২-২১ অর্থবছরে) নীট মুনাফা করেছে ৯৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। কোম্পানিটি আগের অর্থ বছরে মুনাফা করেছিল ৪৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
মুনাফার দিক থেকে এরপরেই রয়েছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল)। ২০২০-২১ অর্থবছরে নীট মুনাফা করেছে ২৫৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি (এপিএসসিএল) নীট মুনাফা করেছে ২৪৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি) মুনাফা করেছে ১৩২ কোটি টাকা, বিআর পাওয়ার জেন (বিআরপিএল) নীট মুনাফা করেছে ৮৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। একমাত্র লোকসানে থাকা কোম্পানি হচ্ছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। কোম্পানিটি উৎপাদনে না থাকায় গত অর্থবছরে ২৩ কোটি ২১ লাখ ৩২ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছে।
অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিরও পোয়াবারো।বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগকে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ভাল ব্যবসা বিবেচনা করা হয়। ৬ বিতরণ কোম্পানিও মুনাফায় রয়েছে। একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবিও ফুলে ফেপে উঠছে। বছরে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পেতে দেখা গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
মাঝে থেকে বিপিডিবি শুধু লোকসান দিয়ে হা-হুতাশ করে যাচ্ছে, ভর্তুকির নাম করে দেওয়া ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে। তারপরও লাফিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ। বিপিডিবি বোকামি ও অসমচুক্তি ফলে আজকে ডুবতে বসেছে, পাশাপাশি জনগণকে বাড়তি দামের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম।
উৎপাদন কোম্পানিগুলোর বাড়ন্ত মুনাফায় মূল কারণ মনে করা হচ্ছে অসম চুক্তিকে। যাচাই-বাছাই না করে ঢালাওভাবে চুক্তি করায় আজকের অপরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। বিপিডিবি যদি দেখেশুনে ক্রয় চুক্তি করতো তাহলে মুনাফা এক বছরে দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব ছিল না।
উৎপাদকের সঙ্গে ক্রয় চুক্তি সম্পাদন করে বিপিডিবি, তাদের উচিত উৎপাদকের মুনাফায় লাগাম টানা। তারা যত বেশি মুনাফা করবে চাপ গিয়ে পড়বে বিপিডিবি তথা ভোক্তাদের উপর। চুক্তিগুলোতে স্বচ্ছতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর ভাইস চেয়ারম্যান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এটাযে পাপের টাকা, চুরির টাকা, তা কেউ বুঝতে চায় না। বরং বুক ফুলিয়ে বলে আমি এতো মুনাফা করেছি।
তিনি বলেন, দর যাচাই-বাছাই করবে না বলে বিশেষ আইন করা হয়েছে্। যাচাই বাছাই করতে গেলেও সঠিক মানুষ পাওয়া কঠিন। চাকরি বাঁচাতে গেলে এগুলো করতে হয়। না হলে তার টিকতে সমস্যা হবে। এখানে সঠিক কাজ করলে নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।
নর্থওয়েস্টের পায়রা ১৩২০ মেগাওয়ার্ট পাওয়ার প্লান্ট প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ১২ শতাংশ রিটার্ন ধরা হয়েছে। কপোরেট ট্যাক্স রাজস্ব থেকে দেওয়া হচ্ছে। অবচয় ব্যায় মাত্রাতিরিক্ত, ক্রয়মুল্য অস্বাভাবিক দেখানো হয়েছে। রামপালের তুলনায় নির্মাণখরচ অনেকগুণ দেখিয়েছে। টাকা নিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল থেকে, শেয়ার দেওয়ার কথা দেওয়া হয় নি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন নাম নিয়ে ভোত্তাদের অর্থ লুণ্ঠন করছে। সঠিকভাবে চুক্তি হলে আজকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ এতো বেড়ে যেত না। কোম্পানিগুলোর বোর্ডে বড় বড় আমলাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে, অধস্তন কর্মকর্তারা মিটিংয়ে বসে সত্যকথাও বলার সাহস পান না। মিটিংয়ে অধস্তন কর্মচারীকে দিয়ে ন্যায্য কথা বলার সংস্কৃতি ভাবা যায় না। যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা ছোট কর্মচারী, আর কোম্পানিতে তার বস বসে আছে। এভাবে কি সঠিক কাজ আশা করা যায়।
অসম চুক্তির পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অদক্ষতার অভিযোগ উঠেছে বিপিডিবির বিরুদ্ধে। যেখানে গ্যাস সরবরাহ করলে তুলনামূলক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো, সেই কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হচ্ছে। তুলনামূলক কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তেমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টে যেহেতু কম জ্বালানিতে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তাই এগুলো প্রথম চালু করা হবে। এরপর যদি ঘাটতি থাকে তাহলে ধাপে ধাপে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা হবে।
কিন্তু গত ৯ মে তারিখের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২৫টি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ৭ হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট। এগুলো ২৪ ঘণ্টা সচল রাখতে মোট গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে ১ হাজার ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ওই দিন মাত্র ৫৭৮ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয় কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়ার্ট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস ঘাটতির কারণে পিক আওয়ারে উৎপাদন করা হয়েছে মাত্র ৩৫ মেগাওয়ার্ট। হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়ার্ট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩০২ মেগাওয়ার্ট, ভেড়ারামা ৪১০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন করা হয়েছে ১৮০ মেগাওয়ার্ট। কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র না চালিয়ে সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহকে অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই পরিমাণ গ্যাস সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করে যখন ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, সেই গ্যাস কম্বাইন্ড সাইকেলে সরবরাহ করা হলে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। তারপর বছরে সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করানো হচ্ছে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।
এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মোঃ মাহবুবুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, অবশ্যই কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু টেকনিক্যাল করণে অনেক সময় সম্ভব হয় না। দেখা যায় যেখানে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে সেখানে গ্যাস দিতে পারছে না জিটিসিএল। তখন বাধ্য হয়ে সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো হয়। কমদামে উৎপাদন করতে পারলে কে না চাইবে!
গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধি প্রস্তাবের উপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে।২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মুসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবির।