সরে গেছে টেকনিপ, বাঁচবে কি রাষ্ট্রের ৬ হাজার কোটি টাকা?
ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ (ইআরএল) এর নির্মাণ থেকে সরে গেছে ফ্রান্সের বহুজাতিক কোম্পানি টেকনিপ। কোম্পানিটির কাজ না করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন ইআরএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান।
তিনি জানিয়েছেন, গত ২৬ মে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দিয়েছে কাজটি তারা করতে চান না। অন্যান্য জায়গায় কাজ নিয়ে ব্যস্ততার কথা জানিয়েছে বাতিল প্রসঙ্গে। এখন বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
তবে এই কাজ বাতিলে ইআরএল তথা রাষ্ট্র বেঁচে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। তারা বলেছেন, যে কাজ ১২ হাজার কোটি টাকায় করে দিতে নির্মাতারা ঘুরঘুর করছেন। সেই কাজ পছন্দের টেকনিপকে দিতে ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে তোড়জোড় শুরু করেছিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এতে রাষ্ট্রের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ পড়তো। এখন একটু আন্তরিক হলে ৬ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জ্বালানি বিভাগ কি সেই আন্তরিকতা দেখাবে। নাকি অন্যকোন কোম্পানিকে চড়াদরে কাজ দেবে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনসহ বিভিন্ন দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখায়। তাদের প্রস্তাব ছিল ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। কোম্পানিগুলো ওপেন টেন্ডারে কাজ নিতেও আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অন্যদিকে ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপ চড়াদরে কাজ পেতে লবিং-তদবির চালিয়ে যাচ্ছিল। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান সাশ্রয়ী দরে কাজ করার পক্ষে ছিলেন অনড়। যে কারণে বেশি সুবিধা করতে পারছিল না টেকনিপ।
গত ২ জানুয়ারি সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান অবসরে চলে গেলে ওই পদে যোগদান করেন সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন। আর তার যোগদানের পর থেকেই দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। বিশেষ আইনে কাজটি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় আর সামনে চলে আসে টেকনিপের প্রস্তাব। তাদের টেকনিক্যাল প্রস্তাব মূল্যায়ন চলছিল তখনই রহস্যজনক কারণে টেকনিপ না বলে দিয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, যারা অযৌক্তিভাবে ব্যয় বাড়িয়ে দেয় তারা দেশ ও জাতির শত্রু। আমরা কমদামে পেলে বাড়তি দামে কেন নেবো! এর পেছনে নানা রকম হিসেব নিকেশ থাকে।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, আর ডিপিএম করা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে। কোয়ালিটির কথা বলে খরচ বেশি করার কথা বলা হচ্ছে। সেই কোয়ালিটি কে যাচাই করছে, তার যোগ্যতা নিয়েও তো প্রশ্ন রয়েছে।
১২ হাজার কোটি টাকার কাজে কেনো ১৮ হতে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে চাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন প্রশ্নের জবাবে ইআরএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান বলেন, আসলে প্রজেক্টটি ভীষণ কমপ্লেক্স। আমরা যদি ইইউ, আমেরিকা কিংবা জাপানি কোয়ালিটি নেই। একটা থেকে অন্যটার দরের তারতম্য হবে। টেকনিপ ছিল পরীক্ষিত তাই তাদের বিষয়ে চিন্তা করা হয়েছিল। আমাদের বর্তমান ইউনিটটি তাদের করা। এটির অর্থনৈতিক লাইফ শেষ হয়েছে ১৯৯৮ সালে তারপরও অনেক ভালোভাবে চলছে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি তেল শোধন করেছে।
এখন কাজটি পিছিয়ে যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মো. লোকমান বলেন, কিছুটা হয়তো পেছাতে পারে, এখনই বলা যাচ্ছে না। চুক্তির পর ৫ বছর সময় লাগবে।
প্রকল্পটি ২০০৮ সালে আলোচনায় আসে। আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় কাজ শুরুর আগেই কেটে যায় এক দশক। প্রথমে ১৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট ধরা হলেও ১০ বারের বেশি ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপিতে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তহবিল থেকে ৮০ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ সরকারি তহবিল থেকে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে।
সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয়ে বিপিসি ঘুরে এখন মন্ত্রণালয়ে গেছে। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান।
ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়নে পরামর্শকের ভূমিকায় আছে ভারতের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। ১১০ কোটি ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে এই প্রকল্পের পরামর্শক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে ইস্টার্ন রিফাইনারির মাত্র ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানির জোগান দেয়। বাকি প্রায় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয় বিপিসিকে। দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। পরিশোধিত তেল না এনে ক্রডওয়েল এনে পরিশোধন করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ টাকা করে সাশ্রয় হয় বলে বিপিসি সূত্র জানিয়েছে।
দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ১৯৬৮ সালে অপারেশন শুরু করে। ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপের করা ওই ইউনিটের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (৩০ বছর) শেষ হলেও এখনও পুরোদমে চলছে। ২০২১ সালে উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে পুরস্কৃত হয়েছে। ১৫ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার এই তেল শোধনাগারটি ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।