গ্যাসের সংকট প্রকৃত নাকি কৃত্রিম!
উৎপাদনজনিত ঘাটতির কারণে গ্যাসের সংকট, নাকি এলএনজি আমদানির পথ খোলা রাখতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখা হয়েছে সে প্রশ্নই এখন অনেকের মনে দানা বেঁধেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এমন প্রশ্ন হরহামেশাই তুলতে শুরু করেছেন বিভিন্ন সভা সেমিনারে। কিছু ঘটনা বাস্তবতার সঙ্গে মিলে সন্দেহ আরও গাঢ় করে তুলছে। দেশে যখন গ্যাসের জন্য হাহাকার চলছে, গ্যাস সংকট সামাল দিতে বিদেশ থেকে চড়াদামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের ৯ নম্বর কূপটি ২০১৭ সাল থেকে গ্যাস নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কূপটি থেকে দৈনিক ১৪ থেকে ১৯ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। যা আমদানিকৃত (১৯ মিলিয়ন) এলএনজির সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক দাম দাঁড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকার উপরে। বছরে এই টাকার অংক দাঁড়ায় প্রায় ১৮’শ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার যুক্তি হচ্ছে পাইপলাইন নেই যে কারণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। কূপটি থেকে গ্যাস গ্রিডে আনার জন্য ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। বাস্তবতা হলো কূপটি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রশিদপুর ৭ নম্বর কূপ পর্যন্ত পাইপলাইন রয়েছে। সেখানে হুকিং করে দিলেই গ্যাস সরবরাহ পাওয়া সম্ভব।
এক প্রশ্নের জবাবে সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, পুরাতন পাইপ লাইনটি ব্যবহার করতে পারলে সময় অর্থ দুটাই সাশ্রয় হতো। ওই পাইপটি ২০ বছরের পুরনো তাই চাপ নিতে পারবে না বলে স্ট্যাডি রিপোর্টে এসেছে। যে কারণে নতুন পাইপ লাইন করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাপেক্সের একজন কর্মকর্তা বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, কিসের ভিত্তিতে তারা পাইপলাইনটি অকেজো মনে করছেন। তারা কি প্রেসার টেস্ট করে দেখেছেন। হাইড্রো টেস্ট করা ১ দিনের বিষয়, সেটাতো করে দেখতে পারতাম। তাহলে আমাদের সামনে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকত। পানি দিয়ে দেড়গুণ চাপ দিয়ে পরীক্ষা করলেই রেজাল্ট পাওয়া সম্ভব। পেট্রোবাংলার প্রকৌশলীরা যদি এটুকু না বুঝেন তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার মনে হয় তারা ইচ্ছা করেই এসব করছে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার জন্য। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করলে কমিশন পাওয়া যাবে, কিন্তু রশিদপুর থেকে গ্যাস তুললে কে কমিশন দেবে। খালি চোখে যা দেখি সব সময় তা ঠিক হয় না। ঘটনা খতিয়ে দেখা উচিত, অনেক সময় স্যাবোটাজ করা হয়।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে প্রশ্ন ছিল পুরাতন পাইপ লাইনের হাইড্রো টেস্ট করা হয়েছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাইড্রো টেস্ট করা হয়নি। হাইড্রো টেস্ট সাধারণ নতুন পাইপের ক্ষেত্রে করা হয়। হাইড্রো টেস্টে পুরাতন পাইপ চাপ নিতে না পারলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে মনে করেন পাইপ লাইন প্রকৌশলীরা।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেই ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন অনিবার্য তাহলে বিগত ৪ বছরে কেনো সেই প্রকল্প নেওয়া গেলো না। এমন প্রশ্নের উত্তরে সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এর জবাব হয়তো আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা ভালো দিতে পারবেন। এমন হতে পারে তখন ১৭ কিলোমিটার পাইপ লাইন করা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো না। এখন এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় গুরুত্ব বেড়েছে।
তিনি বলেন, প্রসেস প্লান্ট পর্যন্ত পাইপলাইনের প্রকল্প অনুমোদন করেছি। টেন্ডার করা হয়েছে, আসছে বোর্ডে হয়তো টেকনিক্যাল প্রস্তাব অনুমোদন হবে। তারপর অর্থনৈতিক প্রস্তাব খোলা হবে। আশা করছি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে উৎপাদনে যেতে পারবো।
আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে কৈলাশটিলা ২ ও ৩ নম্বর কূপে। কূপ দুটিতে পানি চলে এলে যথাক্রমে ডিসেম্বর (২০২০) আগস্ট (২০২১) মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়। নানা কারণে পানি চলে আসতে পারে এরমধ্যে টেকনিক্যাল কারণও থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুতই পরীক্ষা করে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। বিষয়টি সর্বোচ্চ ৭ দিনের বিষয়। অথচ কৈলাশটিলা ২ নম্বর কূপ বসে যাওয়ার প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হতে চলছে। কূপ দু’টি উৎপাদনমুখী করা গেলে দৈনিক ৩০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। একই রকম ঘটনার পর রশিদপুর-৬ নম্বর কূপটিও বসিয়ে রাখা হয়েছে ২০০৬ সাল থেকে।
সিলেট গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কৈলাশটিলা ২ ও ৩ ওয়ার্কওভার করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি কূপে একাধিক স্তর থাকে। ওয়ার্কওভার করে নিচের স্তরে যেতে চাই। ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কৈলাশটিলা ৩ এ প্রথমে মিডল জোন থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়। এরপর ওয়ার্কওভার করে উপরের স্তর থেকে ১৪১ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়। সে কারণে কৈলাশটিলা ৩ বেশি সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে না।
টেকনিক্যাল কোন ত্রুটি থাকলে লগ রান করে স্বল্প সময় ও খরচে নিশ্চিত হওয়া যায়। সেটি কেনো এতোদিন করা হলো না। এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, লগরান করে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় এ কথা সঠিক। তবে আল্টিমেট ফলের জন্য ওয়াকওভার করার বিকল্প নেই।
দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার। ২০১১ সালে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয়, বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডগুলোর সংস্কার করে ৪০০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতে খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট নিয়ে কোন কাজ হয়নি। এই কাজগুলো করতে পারলে এখন স্পর্ট মার্কেট থেকে ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হতো না। আর স্পর্ট মার্কেটের এলএনজি আমদানি করতে না হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না।
স্লামবার্জারের সেই রিপোর্ট নিয়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করার কথা পেট্রোবাংলার। সেই পেট্রোবাংলা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য মনে হচ্ছে এলএনজি আমদানি। পেট্রোবাংলা তথা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার কারণে আজকের এই সংকট বলে মনে করেন জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপরেশন এন্ড মাইন্স) আলী মো. আল মামুনের কাছে প্রশ্ন ছিল, পেট্রোবাংলা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে আজকে এই সংকট হতো না বলে মনে করেন অনেকেই। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, একথা অনেকটা সঠিক। আজকে আমরা চাপটা বুঝতে পারছি। রশিদপুর ৯ নম্বর কূপের গ্যাস এখনও কেনো পাইপ লাইনে আনা গেলো না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এখানে এসেছি দেড় বছর হল আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা ভালো বলতে পারবেন। একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এটি এখন পরিকল্পনা বিভাগ দেখছে।
ক্যাবের সহ-সভাপতি জ্বালানি বিশেষ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সবগুলো কোম্পানির মাথার উপর বসে আছেন নন টেকনিক্যাল আমলারা। যে কারণে আজকে জ্বালানি খাতের নানা রকম সংকট তৈরি হয়েছে। আমলাদের সরাতে না পারলে এই খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কথা বলার জন্য অনেকবার মোবাইল ফোনে কল দিলেও জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন রিসিভ করেন নি। এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনার মন্ত্রণালয়ের দু’টি বিভাগ বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ। বিদ্যুৎ বিভাগ শতভাগ বিদ্যুতায়ন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেও জ্বালানি বিভাগ কেনো তাল মেলাতে পারছে না। এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি বিভাগ কথা শুনতে চায় না। আমি মন্ত্রণালয়ে এসেই বাপেক্সকে ঢেলে সাজাতে অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন করতে বলেছিলাম। তারা ৭ বছর লাগল সেই অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন করতে। আমরা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে জোর দিচ্ছি এখন। ইতিমধ্যে কিছু ফলও পেতে শুরু করেছি।