গ্যাসের মহাসংকট আরও বাড়তে পারে!
গ্যাস সংকট নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন। তাদের কথা কানেই নেয় নি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। আমদানিমুখী নীতি পরিহার না করলে পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্যাস সংকটের কারণে কয়েকদিন ধরেই সারাদেশে ব্যাপক লোডশেডিং করা হচ্ছে। বিদ্যুতে যেখানে ২২’শ এমএমসিএফডির মতো চাহিদা, ৪ জুলাই মাত্র ৮৭৯ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা হয়েছে। গ্যাস সংকট হলে তেলের যোগান বাড়ানোর রেওয়াজ পুরনো, সেই তেলের বাজারও দিনদিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে কারণে আপাতত লোডশেডিংকেই অবলম্বন মনে করছে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক জালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আজকের এই সংকটের মুলে রয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধ্যানে কয়েক দশকের স্থবিরতা। যার পুঞ্জিভূত ফল আজকের এই মহাসংকট। যদি যথাযথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা যেতো তাহলে আজকে এই সংকট হতো না। আমি মনে করি পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানার রিজার্ভ কমে আসছে এখানে যে কোন সময় উৎপাদনে ধ্বস নামতে পারে। আমরা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি, কিন্তু কানেই নেওয়া হয় নি। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে বেশি মনযোগ দেখা গেছে।
তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলার মতো স্পেশালাইজড প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে এবং বাপেক্সের মতো গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানে যদি ননটেকনিক্যাল লোকদের বসিয়ে রাখা হয়। তার ফল বুঝতে জ্যোতিষি হতে হয় না। সরকারের উচিত হবে নন টেকনিক্যাল লোকদের সরিয়ে এখনই তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিশেষ কর্মসূচি শুরু করা। না হলে বড় ধরনের বিপরর্যয় নেমে আসতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখনই সঠিক পথে না গেলে বিপদ আরও বাড়বে। এখন আর স্বাভাবিক কর্মসূচি দিয়ে কাজ হবে না। বিশেষ ঝটিকা কর্মসূচি পরিচালনা করা দরকার। কিছু ওয়ার্কওভার করতে পারলে অল্প সময়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বদরুল ইমাম সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার। ২০১১ সালে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয় বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডগুলোর সংস্কার করে ৪০০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতে খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট রয়ে গেছে অন্ধকারে।
যদিও সম্প্রতি ওয়ার্কওভারের মধ্যেমে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু সাফল্যও এসেছে। কিন্তু এতোদিন কেনো করা গেলো সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছেনা কারও কাছেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, হঠাৎ করে যদি সত্যি সত্যি কয়েকটা কূপ বন্ধ হয়ে যায়, সত্যি একটা জটিল সমস্যার মধ্যে পড়বো। তখন আমাদের তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি চালাতে হবে, গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হবে, রেশনিং করতে হবে। তখন একটি জটিল অংক তৈরি হবে। আমরা একটি অত্যন্ত শোচনীয় জায়গায় অবস্থান করছি। কপাল ভাল হলে ২০২৭-২০২৮ পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যাবে। আর খারাপ হলে দু্’এক বছরেই মধ্যেই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে বিবিয়ানা ড্রাই (গ্যাস শেষ) হবে এটাতো অংক করে বলা হয়েছে, এটা সবাই জানে। বিবিয়ানাতে আর বেশি গ্যাস থাকার কথা না। কতটা রিজার্ভ ছিল আর কতটা উত্তোলন করা হয়েছে সে হিসেব করলেইতো ফল বের হয়। তিতাস গ্যাস ফিল্ড অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, ওখানে আমরা বুঝে শুনে কাজটি করছি। বিবিয়ানাতো বিদেশিদের হাতে তাদেরতো যতো বেশি উৎপাদন ততো লাভ। অতিরিক্ত উৎপাদন করে বাখরাবাদের কুপগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য পড়ছে ১.২৬ টাকা, বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন থেকে ২.৮৯ টাকা, তাল্লো থেকে ৩.১০ টাকা করে দরে কেনা হচ্ছে। অন্যদিকে এলএনজির ক্রয়মূল্য ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে।
বর্তমানের চাহিদাই গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না, প্রতিদিনেই রেশনিং করতে হচ্ছে, তারপরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সংকট সামাল দিতে গিয়ে অনেক গ্যাস ফিল্ড থেকে অত্যন্ত ঝূঁকিপুর্ণভাবে বাড়তি গ্যাস উৎপাদনের পথ বেছে নিয়েছে। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগে ১৪৯ এমএমসিএফডি উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও কমবেশি ৮৬ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশ সবগুলো গ্যাস ফিল্ড থেকে ২৭০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত উৎপাদন করেছে। ৪ এপ্রিল উৎপাদন করেছে মাত্র ২৩’শ এমএমসিএফডি। ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদনে বড় ধরণের ধ্বংস নামতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ ধারণা করা হয়। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরও ৭ টিএসএফ’র মতো। প্রতি বছর প্রায় ১ টিসিএফ’র মতো গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে এতে প্রমাণিত মজুদ ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে দ্রুত শিল্পায়ন ও ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কারণে গ্যাসের চাহিদাও প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে।
কয়েক বছর ধরেই গ্যাস সংকটের কথা উঠলেই আমদানির কথা বলে আসছে পেট্রোবাংলা। আমদানিকে যেভাবে সামনে আনা হয়েছে বাস্তবতা মোটেই অনুকূলে নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) ১ হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জণ করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে আর ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়, ২০১৮ সালের আগস্টে প্রথম ইউনিট ৫০০ এমএমসিএফডি আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ইউনিট এসেছে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। সাগর উত্তাল হলেই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। এলএনজি আমদানি বাড়াতে মাতারবাড়িতে ১ হাজার এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখনও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা যায় নি। অন্যদিকে মাতারবাড়িতে ও পায়রাতে পৃথক দু’টি এফএসআরইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও এখন কাগজে সীমাবদ্ধ। চুক্তির পর ১৮ মাসের অধিক সময় প্রয়োজন পড়বে।
অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির পথ প্রায় বন্ধ। এরসঙ্গে রয়েছে অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার দরের ইস্যু। যার ফল আমরা হাড়ে হাড়ে টেরপেতে শুরু করেছি।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, ত্রিপুরা তার স্বল্প আয়তনে কূপ খনন করেছে ১৬০ টি। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে মাত্র ১১টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ গত ১১০ বছরে মাত্র ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার হয়েছে। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই রয়ে গেছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারেই তা মেনে চলেনি। বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জণ করলেও সেখানে কোনো কাজ করা যায় নি। সাগরে পিএসসি (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) আহ্বান করা হলে আগ্রহ দেখাচ্ছেনা বিদেশি কোম্পানিগুলো।
কোম্পানিগুলোর অভিযোগ ইতোপুর্বে সাগরে পরিচালিত সিচমিক সার্ভের তথ্য পেট্রোবাংলা তালাবদ্ধ করে রেখেছে। এগুলো না দেখতে পেলে খালি খালি কেউ জলে টাকা ঢালতে আসবে না। অতীতে এই তথ্য কেনার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও এখন রহস্যজনক কারণে তালাবদ্ধ করা হয়েছে। আর পেট্রোবাংলার কর্তাদের অনুযোগ হচ্ছে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলো আসতে চাইছে না। যদিও পেট্রোবাংলার এই মতের সঙ্গে অনেকেই একমত নন। তারা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশি ভারত ও মায়ানমারের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য রয়েছে বাংলাদেশের হাতে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বঙ্গবন্ধু সরকার ছাড়া আরও কোনো সরকারেই এই দিকে যথেষ্ট মনযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গ্যাসের ঘাটতি মোকাবেলায় আরেকটি ভালো উপায় হতে পারতো দেশীয় কয়লার বিশাল মজুদ।কিন্তু সেই ট্রেন মিস করেছে বাংলাদেশ।
জ্বালানি বিভাগের যখন বেহাল অবস্থা, তখন বিদ্যুৎ বিভাগ নতুন নতুন গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। ২০১৬ সালের রিভাইস মাস্টারপ্লান অনুযায়ী ২০২২ সালে ১১৮৮ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমরা এখন যেভাবে আমদানি নির্ভরতার দিকে যাচ্ছি ২০৩০ সালে ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে জ্বালানি আমদানিতে। ফরেন রিজার্ভের সিংহভাগ যদি জ্বালানি ব্যয় করি তাহলে উন্নত দেশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই যাদের এই দর্শনে বিশ্বাস রয়েছে, তারা দয়া করে রাস্তাটা ছেড়ে দেন। জরুরি ভিত্তিতে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর সংস্কার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা উচিত। এখন সমস্যা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ৩দিনে যে সিদ্ধান্ত দিতেন, সেটি এখন ৩ মাসেও হয় না।