ডিজেলের ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলে মাসে দিতে হবে ১৭৬ কোটি টাকা

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ডিজেলের ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলে মাসে দিতে হবে ১৭৬ কোটি টাকা

ডিজেলের ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলে মাসে দিতে হবে ১৭৬ কোটি টাকা

বসিয়ে রাখলেও ডিজেল ভিত্তিক ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে মাসে (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হবে ১৭৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে ৬টি বেসরকারি ও ১টি সরকার মালিকানাধীন কোম্পানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে বলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানিয়েছে।

সবচেয়ে ব্যয়বহুল ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১০টি। যার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১২৮৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মা মালিকানাধীন ৩ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (৬০ মেগাওয়াট) জন্য কোন ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় না। অন্য ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও কাড়ি কাড়ি টাকা গুণতে হবে। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে ইউনিট প্রতি জ্বালানি খরচ পড়ে ২০ টাকার উপরে।

বিজ্ঞাপন

পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৫০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চালালে দৈনিক প্রায় ২৩ কোটি টাকার ডিজেল প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখলে এই টাকা সাশ্রয় হবে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো খুব কম সময়েই ৫০ শতাংশ হারে চালানোর নজীর রয়েছে। পিডিবির তথ্য মতে গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে চালানোর রেকর্ড রয়েছে। ২০ শতাংশ হারে ধরলে দৈনিক সাশ্রয় হবে ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব সাইফুল আজাদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে (জুলাই/২১-মার্চ/২২) ওই ৭টি ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে পরিশোধ করতে হয়েছে। একই সময়ে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবিকে দিতে হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করে চুক্তিতে অনেক অসংগতি রয়েছে। যার ফলে অনেক বেসরকারি কোম্পানি বসে বসে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বিদ্যুতের সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না বিদ্যুৎ খাতকে।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি চড়া দামে আমদানি করতে গিয়ে নানামূখী সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। রিজার্ভের উপর টান ঠেকাতে স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধের পর ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এতে করে ঘাটতি বিদ্যুৎ লোডশেডিং দিয়ে সামাল দেওয়া ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। পাশাপাশি পরিবহনে জ্বালানির ব্যবহার কমানোর উপায় খোজা হচ্ছে। অফিস আওয়ার কমিয়ে আনার বিষয়েও চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, লোডশেডিং দিয়ে বৈদেশিক মূদ্রা রিজার্ভ রক্ষা হলেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বিতরণ কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কবলে পড়বে। ঋণের ভারে ন্যূজ পিডিবি আরও রুগ্ন হয়ে পড়তে পারে। লোডশেডিংকে সাময়িক সমাধান হিসেবে দেখা হলেও লন্ডভন্ড করে দিতে পারে বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনাকে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলেও ক্যাপসিটি চার্জ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পিডিবি। বেশি উৎপাদন হলে বেশি বিক্রি হয় এতে গড় করে উৎপাদন খরচ কিছুটা কমে আসতো। পাশাপাশি সরকারের দেওয়া ভর্তুকি মিলিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ সামাল দেওয়া হতো।

সেই পথ বন্ধ হয়ে গেলে পিডিবি চরম সংকটে পড়তে পারে। একইসঙ্গে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর রাজস্বে টান পড়বে। মোট বিক্রিত ইউনিট ধরে রাজস্ব বিবেচনা করা হয়। বিক্রি কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের আয় কমে যাবে। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে লোডশেডিং চললে বিতরণ কোম্পানিগুলোও রুগ্ন হয়ে পড়বে।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক তথ্যে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে (জুলাই/২১-মার্চ/২২) ৬১টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা। একই সময়ে ১২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিপরীতে দিতে হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ১৬টি সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থ বছরের হিসেবে দেখা গেছে ৬২টি আইপিপি ও এসআইপিপি ১১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ওই অর্থ বছরে ১৯টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে চার্জ দিতে হয়েছে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি, বেসরকারি, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।

চার্জ ও অন্যান্য মাশুল দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ও বিক্রির মধ্যে বিশাল তারতম্য রয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়ছে সাড়ে ৮ টাকার মতো। আর পিডিবি পাইকারি ৫.০৮ টাকা দরে বিক্রি করছে। ক্রয় বিক্রয়ের ভারসম্য আনতে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকির কথা বলা হলেও কাগজে কলমে ঋণ হিসেবে দিয়ে এসেছে সরকার। ওই টাকার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান ব্যবস্থায় এই ঘাটতি আর বেড়ে যাবে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আমরা একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছি। ইউক্রেন সংকটের পরে জ্বালানি তেলের দাম আকাশচুম্বি হয়ে গেছে। অনেক উন্নত দেশ লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরাও সাশ্রয়ী হওয়ার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।