বিদ্যুতের রাঘববোয়াল সামিট, ইউনাইটেড, সিকদার, ওরিয়ন, কনফিডেন্স, ডরিন

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বিদ্যুতের রাঘববোয়াল সামিট, ইউনাইটেড, সিকদার, ওরিয়ন, কনফিডেন্স, ডরিন

বিদ্যুতের রাঘববোয়াল সামিট, ইউনাইটেড, সিকদার, ওরিয়ন, কনফিডেন্স, ডরিন

বিদ্যুতের চুনোপুটি থেকে রাঘববোয়ালে পরিণত হয়েছে সামিট, ইউনাইটেড, সিকদার, ওরিয়ন, কনফিডেন্স, বাংলাট্রাক ও ডরিন গ্রুপ । ছয় কোম্পানির ২৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য বার্তা২৪.কম’র হাতে এসেছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে মাসে ৪২১ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলুক আর না চলুক প্রত্যেক মাসে এই টাকা (ক্যাপাসিটি) দিতেই হবে। এরমধ্যে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১৫ বছর মেয়াদী। অর্থাৎ আগামী ১৫ বছর এই ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারা এতই প্রভাব বিস্তার করছে অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের দেখানো পথেই ছুটছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা না দেখলেও দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ। কিছু কর্মকর্তা বিশেষ সুবিধা নিয়েও স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নিয়েও রয়েছে নানান গুঞ্জন।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতে সবার শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। কোম্পাটির মালিকানাধীন ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২ হাজার ২৫৫ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৯ শতাংশ তার হাতে। শিগগিরই আরও এক হাজার মেগাওয়াট যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। দেশের পুঁজিবাজারে সামিট পাওয়ার, সামিট পোর্ট অ্যালায়েন্স ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল) নামে তিনটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে।

কয়েক বছর আগেও ছোট-খাটো ব্যবসায়ী থাকলেও এখন সিঙ্গাপুরের মতো জায়গাতেও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর তালিকায় জায়গা পেয়েছেন। সিঙ্গাপুরের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল ভারতের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেছে। কোরিয়া, নেপাল ও ভুটানে বিনিয়োগের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশের বাইরে কোম্পানি খোলা ও টাকা নিয়ে যাওয়া নিয়ে রয়েছে নানা রকম বিতর্ক। অনেক সময় ওভার ইনভয়েজ ও আন্ডার ইনভয়েজের মাধ্যমে টাকার পাচারের অভিযোগ রয়েছে সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে। বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি খাতেও এখন একচেটিয়া দৌরাত্ম্য লক্ষ্যণীয়। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নিয়েও নানা রকম মুখরোচক আলোচনা রয়েছে বাজারে।

বিজ্ঞাপন

সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন ১৮ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের তথ্য পাওয়া গেছে। ১৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ১২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার উপরে। ওই ৭ বিদ্যুতের কেন্দ্রের বিপরীতে জুলাই/২১- মার্চ/২২ (৯ মাস) ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৬১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।


বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাট্রাকের মালিকানায় রয়েছে ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রতি মাসে ১০৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। গত ৯ মাসে বাংলাট্রাকের ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা।


ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ১০৮ কোটি টাকা। বিগত ৯ মাসে কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পেয়েছে ৯৮৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার উপরে।

বিএনপি ঘরানার কোম্পানি খ্যাত ওরিয়ন গ্রুপ চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে বর্তমান সরকারের সময়েও। অনেক সময়ে আওয়ামী ঘরানারা কোম্পানির চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে এসেছে। ওরিয়ন সর্বপ্রথম কয়লা ভিত্তিক ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ছাড়পত্র পায়। ওই ৩টি আলোর মুখ না দেখতেই আরও ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এলওআই ইস্যু করা হয়। প্রথম ধাপের ৩টি ২০১৬ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও এখন পর‌্যন্ত দৃশ্যমান নয়। নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে না পারলে এলডি (জরিমান) করার কথা। পাশাপাশি লাইসেন্স বাতিল করার কথা। কিন্তু এখানে বিদ্যুৎ বিভাগ পুরাই নিরব। ৬ বছর ধরে শুধু সময় বাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া হচ্ছে।


ওরিয়ন গ্রুপ কয়লার ব্যর্থ হলেও তেল ভিত্তিক ৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক বলে জানা গেছে। যার বিপরীতে প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করছে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকার উপরে। ৯ মাসের চার্জ এসেছে ২৭৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।


বাংলাদেশের ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনের (বিপপার) সভাপতি পদে রয়েছে কনফিডেন্স গ্রুপের মালিক ইমরান করিম। কনফিডেন্স গ্রুপের রয়েছে ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বগুড়ায় দু’টি এবং রংপুরে অবস্থিত একটি। প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা ১১৩ মেগাওয়াট করে। তেলভিত্তিক ওই তিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ ৩৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা।  ৩টির উৎপাদন ক্ষমতা একই হলেও চার্জের ব্যাপক তারতম্য লক্ষ্যণীয়। রংপুরের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মাসে ১১ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার ৪৩০ টাকা দেওয়া হলেও একই ক্ষমতার বগুড়া ইউনিট-২ এর বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে ১৩ কোটি ২২ লাখ ২৯ হাজার ৩৮৮ টাকা।


সিকদার গ্রুপের মালিকাধীন রয়েছে ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে রয়েছে। পাওয়ার প্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট ও পাওয়ার প্যাক মুতিয়ারা জামালপুর ৯৫ মেগাওয়াট। এ দুই বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুব একটা চালাতে দেখা না গেলেও প্রতিমাসে গুণতে হচ্ছে ১২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। গত ৯ মাসে ১১৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হয়েছে।


ডরিন গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এগুলো টাঙ্গাইল, ফেনী ও নরসিংদীতে অবস্থিত। প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা ২২ মেগাওয়াট করে। ডরিনকে প্রত্যেক মাসে ক্যাপাসিটি বাবদ দিতে হচ্ছে ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকার উপরে। ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর ওই কোম্পানিটি শেয়ারবাজারেও কারসাজির দায়ে অভিযুক্ত। এক দফায় জরিমানাও গুণতে হয়েছে।

এর বাইরে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের দেশ এনার্জি, এনার্জিপ্যাক, ডরিন গ্রুপ, সিনহা গ্রুপ, রিজেন্ট গ্রুপ, আনলিমা গ্রুপ রয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিকে অসামঞ্জস্য বলে মন্তব্য করেছেন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যারা চুক্তি করেছেন তাদের সততা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যথাযথ ভাবে চুক্তি না হওয়া বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এখন দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের উপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। আদৌ এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা সেটাও ক্ষতিয়ে দেখা দরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক তথ্যে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে (জুলাই/২১-মার্চ/২২) ৬১টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা। একই সময়ে ১২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিপরীতে দিতে হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ১৬টি সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থ বছরের হিসেবে দেখা গেছে ৬২টি আইপিপি ও এসআইপিপি ১১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ওই অর্থ বছরে ১৯টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে চার্জ দিতে হয়েছে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি, বেসরকারি, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র এর মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ সম্পর্কে অনেকের ধারণা পরিষ্কার নয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের খরচ রয়েছে, সেই বিনিয়োগের সঙ্গে ব্যাংক ঋণের অন্যান্য চার্জ যুক্ত হয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। অনেক দেশেই এই চর্চ্চা রয়েছে। সরকার যদি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতো, সেখানে বিনিয়োগ করতে হতো।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অবশ্যই সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দর চূড়ান্ত করা হয়েছে।