মজুদে এগিয়ে, উত্তোলনে পিছিয়ে কেনো দেশীয় গ্যাসফিল্ড!
যখন গ্যাসের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে ঠিক সে সময়েও বিশাল রিজার্ভ নিয়ে বসে রয়েছে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো। বিবিয়ানায় ১.২২ টিসিএফ মজুদ থেকে আমেরিকান কোম্পানি শেভরন দৈনিক উৎপাদন করছে ১২৩৭ এমএমসিএফ। প্রায় দ্বিগুণ মজুদ (২.০২৬ টিসিএফ) থাকার পরও কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ডে মাত্র ৬৮ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
বিবিয়ানার তুলনায় গ্যাসের রিজার্ভ অনেক বেশি তিতাস ও রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডেও। সেখানেও আশানূরূপ উৎপাদন করা হচ্ছে না। ১৯৬০ সালে আবিষ্কার হওয়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের অবশিষ্ট মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে) রয়েছে (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ হিসেব অনুযায়ী) ১.৭৭৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। রশিদপুরে গত ১ জুলাই গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৪৪ এমএমসিএফ।
রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের ৯ নম্বর কূপটি ২০১৭ সাল থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত হলেও বসিয়ে রাখা হয়েছে। কূপটি থেকে দৈনিক ১৪ থেকে ১৯ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। যা আমদানিকৃত (১৯ মিলিয়ন) এলএনজির সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক দাম দাঁড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকার উপরে। বছরে এই টাকার অংক দাঁড়ায় প্রায় ১৮’শ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার যুক্তি হচ্ছে কূপটির সঙ্গে পাইপলাইন নেই যে কারণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। কূপটি থেকে গ্যাস গ্রিডে আনার জন্য ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। বাস্তবতা হলো কূপটি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রশিদপুর ৭ নম্বর কূপ পর্যন্ত পাইপলাইন রয়েছে। সেখানে হুকিং করে দিলেই গ্যাস সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। বার্তা২৪.কম’এ রিপোর্টের পর সম্প্রতি পুরাতন পাইপ লাইনটির হাইড্রো টেস্ট করা হয়। এতে পাইপটি ব্যবহার উপযোগি রয়েছে বলে জানা গেছে। অথচ মহাসংকটের মধ্যেও ৫ বছর ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে কূপটি। এ রকম অনেক অব্যবস্থাপনার নজির দৃশ্যমান সর্বত্র।
রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের মালিকানা রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির হাতে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, হাইড্রো টেস্টে পুরাতন পাইপটি ব্যবহার উপযোগি পাওয়া গেছে। পাইপ লাইন নির্মাণের জন্য ১৭ কিলোমিটারের যে প্রকল্প ছিল, সেখানে দরপত্রে লাইনের দৈর্ঘ্য কমানো বাড়ানোর অপশন রাখা হয়েছিল। এখন পুরাতন পাইপ লাইনের সঙ্গে হুকিং করতে যে পরিমাণ লাইন বসাতে হবে, সেটুকু করা হবে। আশা করছি ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতোদিন কেনো এই কাজটি করা গেলো না। জবাবে বলেন, আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা হয়তো ভালো বলতে পারতেন, তবে আমার মনে হয়, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে সফল মনে করা হচ্ছে। আগে হয়তো বাণিজ্যিকভাবে সফল বিবেচনা করা হয় নি।
বিবিয়ানার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ মজুদ রয়েছে তিতাস গ্যাস ফিল্ডেও। ১৯৬২ সালে অবিস্কৃত তিতাস গ্যাস ফিল্ডে উত্তোলন শেষে অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে) রয়েছে (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ হিসেব অনুযায়ী) ১.৪৩৬ টিসিএফ। সেখানে দৈনিক উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৪১০ এমএমসিএফ গ্যাস। যা বিবিয়ানার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ মাত্র।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার। ২০১১ সালে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয় বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডগুলোর সংস্কার করে ৪০০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতে খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট রয়ে গেছে অন্ধকারে। আমরা ভূল পথে এগিয়ে চলছি। এখনই সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আপনার মতো আমারও প্রশ্ন ছিল আমরা এতো কম উৎপাদন করছি কেনো! আমাদের দেশীয় কোম্পানির কূপগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কম (১০-২০এমএমসিএফডি)। প্রযুক্তিগতভাবেই উৎপাদন ক্ষমতা কম। অন্যদিকে শেভরনের কূপগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ থেকে ৭০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত। প্রযুক্তিগতভাবেই তারা এগিয়ে রয়েছে। আমরা কম করে উৎপাদন করছি অনেকদিন ধরে চলবে আর ওরা বেশি করে উৎপাদন করছে দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, বিবিয়ানা নতুন এলাকায় অনুসন্ধ্যান কূপ খনন করার প্রস্তুতি নিয়েছে। যদি গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে আরও ৩টি কূপ খনন করবে। সফল হলে ২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। ২০১১ সালে তারা একটি রিপোর্ট দাখিল করে পেট্রোবাংলায়। স্লামবার্জারের ওই রিপোর্ট নিয়ে কোন কাজ না হওয়ার কারণ কি। জবাবে নাজমুল আহসান বলেন, বিষয়টি অনেক আগের আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তার আগে কিছু বলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত জুলাই-ডিসেম্বর সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ দৈনিক সিস্টেম লসের পরিমাণ ২৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেছেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের ওপরে সিস্টেম লস নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়। এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
অর্থাৎ প্রায় ৬ শতাংশ চুরিকে সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দৈনিক চুরি যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে চড়াদামে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট। স্পর্ট মার্কেটের এলএনজির মূল্যের (ঘনমিটার ৫০টাকা আমদানি শুল্কসহ) সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক চুরি যাওয়া ৬ শতাংশ গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটিতে। যা বছরে ১ লাখ ৩ হাজার ৫’শ কোটি টাকার মতো। দাম বেড়ে যাওয়ার স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের কাছে প্রশ্ন ছিল দশ শতাংশের উপর গ্যাসের সিস্টেম লস। আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশের নিচে থাকলে তাকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। তার অর্থ দাঁড়ায় আমাদের ৮ শতাংশের উপরে গ্যাস চুরি হয়ে যাচ্ছে, যা সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা চুরি ঠেকানোর জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক অভিযান করেছি যা আপনারা দেখে থাকবেন। সম্প্রতি বিইআরসি আদেশ দিয়েছে ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে গ্যাসের সিস্টেম লস। কোন বিতরণ কোম্পানি ব্যর্থ হলে তার দায় তাকেই নিতে হবে। গ্রাহক কিংবা অন্য কারো ওপর দায় চাপাতে পারবে না। এভাবে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সিস্টেম লস কমানোর জন্য।
নাজমুল আহসান আরও বলেন, মানলাম বিতরণ কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি গ্রাহকদেরও সচেতন হওয়ার অনুরোধ করবো। তারা অসৎ উপায়ে সংযোগ নেবেন কেনো।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আজকের এই সংকটের মুলে রয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধ্যানে কয়েক দশকের স্থবিরতা। যার পুঁঞ্জিভূত ফল আজকের এই মহাসংকট। যদি যথাযথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতো তাহলে আজকে এই সংকট হতো না। আমি মনে করি পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানার রিজার্ভ কমে আসছে এখানে যে কোন সময় উৎপাদনে ধ্বস নামতে পারে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে বেশি মনোযোগ দেখা গেছে।
বাংলাদেশে ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ ধারণা করা হয়। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরও ৭ টিএসএফ’র মতো। প্রতি বছর প্রায় ১ টিসিএফ’র মতো গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে এতে প্রমাণিত মজুদ ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে দ্রুত শিল্পায়ন ও ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কারণে গ্যাসের চাহিদাও প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে। আর ঘাটতি মোকাবেলায় বাজেটে এলএনজি আমদানির কথা বলা হয়েছে।
আমদানিকে যেভাবে সামনে আনা হয়েছে বাস্তবতা মোটেই অনুকূলে নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) ১ হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জণ করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে আরও ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়। সাগর উত্তাল হলেই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। এলএনজি আমদানি বাড়াতে মাতারবাড়িতে ১ হাজার এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখনও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা যায় নি। অন্যদিকে মাতারবাড়িতে ও পায়রাতে পৃথক দু’টি এফএসআরইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও এখন কাগজে সীমাবদ্ধ। চুক্তির পর ১৮ মাসের অধিক সময় প্রয়োজন পড়বে।
অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির পথ প্রায় বন্ধ। এরসঙ্গে রয়েছে অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার দরের ইস্যু। স্পর্ট মার্কেট থেকে মাত্র ৩ শতাংশ এলএনজি আমদানি করায় সামাল দিতে পুরো গ্যাসে ১১৭ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে পেট্রোবাংলা। ভবিষ্যতে আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেলে বাজারদর কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলাই বাহুল্য। অথচ হাতের কাছেই অনেক বিকল্প রয়ে গেছে। যা দীর্ঘদিন ধরেই অনাদরে পড়ে রয়েছে। আর এ কারণেই আজকের মহাসংকট বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।