গ্যাস খাতের অদক্ষতার চূড়ান্ত নজির রশিদপুর- ৯
কোন রকম পরীক্ষা ছাড়াই বলা হচ্ছিল পাইপলাইনটি অকেজো। ৫ বছর পর অনেকটা মিডিয়ার চাপেই পরীক্ষা করে দেখা গেলো পাইপলাইনটি ব্যবহার উপযোগী রয়েছে।
দেশ গ্যাস সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও বিষয়টি কোনই গুরুত্ব পায় নি পেট্রোবাংলা কিংবা জ্বালানি বিভাগের কাছে। অথচ হাইড্রো টেস্ট করার বিষয়টি মাত্র কয়েক ঘণ্টার কাজ। পানি দিয়ে দেড়গুণ চাপ দিলেই জানা যায় পাইপটির সক্ষমতা। এই সামান্য কাজটুকু করতে ৫ বছর সময়ক্ষেপন করা হলো। এদিকে জ্বালানি বিভাগের নজর কম, তাদের নজর ছিল আমদানির দিকে। বিগত ২টি বাজেটে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা দেখলেও হতাশ হতে হয়। দু’টি বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে গ্যাসের সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানির উদ্যোগ দেওয়া নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে তাদের কোনই মনোযোগ দেখা যায় নি।
রশিদপুরের মতো ছোট ছোট অনেক ঢিলেমির মাসুল দিতে হচ্ছে দেশের জ্বালানি খাতকে। কূপটি থেকে দৈনিক ১৪ থেকে ১৯ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। যা আমদানিকৃত (১৯ মিলিয়ন) এলএনজির সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক দাম দাঁড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকার উপরে। বছরে এই টাকার অংক দাঁড়ায় প্রায় ১৮’শ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার যুক্তি হচ্ছে পাইপলাইন নেই যে কারণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। কূপটি থেকে গ্যাস গ্রিডে আনার জন্য ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সেই প্রকল্পের কাগুজে প্রক্রিয়াও চলছে ঢিমেতালে। ভাবখানা এমন যেনো এই গ্যাস এতো জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বার্তা২৪.কম একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। বাধ্য হয়ে সিলেট গ্যাস ফিল্ড চলতি সপ্তাহে হাইড্রো টেস্ট করে পাইপটি ব্যবহার উপযোগী বলে জানতে পারে। এখন ৭ নম্বর কূপের বিদ্যমান লাইনে হুকিং করে দিলেই (রশিদপুর-৯) উৎপাদনে যেতে পারবে। এই চেয়ে স্বস্তিদায়ক খবর এই মুহূর্তে খুব কমই রয়েছে।
তবে সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফসিএল) একটি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তারা পাইপলাইনের ডিপিপিতে দৈঘ্য কমানো বাড়ানোর অপশন রেখেছিল। এখন ৭ নম্বর কূপের সঙ্গে হুকিং করতে যেটুকু প্রয়োজন পড়ে সেটুকু করা হবে। ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন এসজিএফসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান।
এসজিএফসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে প্রশ্ন ছিল ২০১৭ সাল থেকে গ্যাস কূপটি ফেলে রাখা হলো কেনো। উত্তরে বলেছেন আগের ম্যানেজমেন্ট ভালো বলতে পারবে। তবে একটি বিষয় বলতে পারি, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া অনেক প্রকল্প এখন গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছে, যা আগে হয়তো বাণিজ্যিকভাবে সফল বিবেচনা করা হয় নি। আমার মনে হয় রশিদপুর তখন বাণিজ্যিকভাবে উপযুক্ত মনে করা হয় নি। এখন গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গুরুত্ব বেড়েছে।
রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০ সালে। ফিল্ডটিতে গ্যাসের প্রমাণিত মজুদ ধরা হয় ১.৬০ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট), সম্ভাব্য মজুদ যোগ করলে দাঁড়ায় ২.৪৩ টিসিএফ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোমোট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে দশমিক ৫৫ টিসিএফ। সে হিসেবে গ্যাস ফিল্ডটিতে অবশিষ্ট গ্যাস মজুদ রয়েছে ১.৭৭ টিসিএফ। উৎপাদনে থাকা ৫টি কূপের দৈনিক গ্যাস উত্তোলন ক্ষমতা রয়েছে ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ২৫ জুলাই উত্তোলন করেছে মাত্র ৪৩.৭ মিলিয়ন ঘনফুট।
একই সময়ে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন তুলনামূলক মজুদ কম থেকেও প্রায় কয়েক’শ গুণ বেশি উত্তোলন করছে। শেভরনের মালিকানাধীন বিবিয়ানায় গ্যাস ফিল্ডের অবশিষ্ট মজুদ রয়েছে মাত্র ১.২২ টিসিএফ। শেভরন ২৬টি কূপ দিয়ে দৈনিক উৎপাদন করছে ১২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখানেও পিছিয়ে দেশীয় কোম্পানির মালিকাধীন রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আপনার মতো আমারও প্রশ্ন ছিল আমরা এতো কম উৎপাদন করছি কেনো! আমাদের দেশীয় কোম্পানির কূপগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কম (১০-২০এমএমসিএফডি)। প্রযুক্তিগতভাবেই উৎপাদন ক্ষমতা কম। অন্যদিকে শেভরনের কূপগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ থেকে ৭০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত। প্রযুক্তিগতভাবেই তারা এগিয়ে রয়েছে। তবে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তার জন্য নানামূখী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে কৈলাশটিলা ২ ও ৩ নম্বর কূপে। কূপ দুটিতে পানি চলে এলে যথাক্রমে ডিসেম্বর (২০২০) আগস্ট (২০২১) মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়। নানা কারণে পানি চলে আসতে পারে এরমধ্যে টেকনিক্যাল কারও থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুতই পরীক্ষা করে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। বিষয়টি সর্বোচ্চ ৭ দিনের বিষয়। অথচ কৈলাশটিলা ২ নম্বর কূপ বসে যাওয়া প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হতে চলছে। কূপ দু’টি উৎপাদনমুখী করা গেলে দৈনিক ৩০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। একই রকম ঘটনার পর রশিদপুর-৬ নম্বর কূপটিও বসিয়ে রাখা হয়েছে ২০০৬ সাল থেকে।
পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে, ২৫ জুলাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদার বিপরীতে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট। একই দিনে সার উৎপাদনে ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে ১৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, ননগ্রিড পাওয়ারে ৯৪.৭ মিলিয়ন ঘনফুট ও আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পসহ অন্যান্য খাতে ১৬৪২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। ওই দিন গ্যাস সংকটের কারণে ২১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ থেকেছে। বেশ কয়েকটিতে আংশিক উৎপাদন হয়েছে।
এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন প্রয়োজনীয় সক্ষমতা থাকার পরও সারাদেশে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। প্রথম দিকে ১ ঘণ্টার লোডশেডিংরে কথা বলা হলেও তা কোথাও কোথায় ৮ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যেভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তা কখনই দেওয়া যায় নি। যে কারণে আজকের সংকটের উদ্ভব হয়েছে। এখনই জরুরি ভিত্তিক কিছু কাজ করা দরকার। বিশেষ করে বর্তমান গ্যাস ফিল্ড থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে সেগুলো কাজে লাগানো উচিত।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেছেন, দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার। ২০১১ সালে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয় বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডগুলোর সংস্কার করে ৪০০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতে খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট রয়ে গেছে অন্ধকারে। আমরা ভূল পথে এগিয়ে চলছি। এখনই সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।