গ্যাসের অভাবে এখনই বন্ধ, তবুও গ্যাসভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র
গ্যাসের অভাবে গত মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) শুধু ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোদমে চলেছে, বন্ধ ছিল ২১টি, আর আংশিক উৎপাদনে ছিল ৩০ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ওই দিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫২ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় মাত্র ৯৬১ মিলিয়ন ঘনফুট।
তারপরও নতুন নতুন গ্যাস (এলএনজি) ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ১১ হাজার ২৮২ মেগাওয়াট এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আনার প্রক্রিয়া চলমান বলে বিদ্যুৎবিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
২০২৫ সালের জুনে উৎপাদনে আসবে হরিপুর ২৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি পাওয়ার প্লান্ট। ২০২৬ সালের জুনে উৎপাদনে আসবে ঘোড়াশাল ২২৫ সিসিপিপি পাওয়ার প্লান্ট ও ময়মনসিংহ ৪০০ মেগাওয়াট সিসিপিপি পাওয়ার প্লান্ট। ২০২৭ সালে আসবে আরও দু’টি, এগুলো হচ্ছে গজারিয়া ৫৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট ও সিদ্ধিরগঞ্জ ৫৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি পাওয়ার প্লান্ট। ২০৩০ সালে উৎপাদনে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে ফেনী ৫৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি পাওয়ার প্লান্ট ও ভেড়ামারা ৫৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি পাওয়ার প্লান্ট। এছাড়া যৌথ বিনিয়োগে রয়েছে ৫৩৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো হচ্ছে পায়রা ২৪০০ মেগাওয়াট (২০২৫-২০২৭) ও মহেশখালী ২৪০০ মেগাওয়াট (২০২৭-২০২৮) এবং ২০২৮ সালের জুনে ৫৮৭ মেগাওয়াট।
গ্যাসের বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে হিমশিম ক্ষেতে হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা আরও নাজুক হবার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেন সংকটের কারণে গ্যাস দাম আকাশচুম্বির পাশাপাশি সরবরাহের রয়েছে চরম ঘাটতি। ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলো হন্যে হয়ে গ্যাসের তালাশ করছে। অন্যদিকে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডে এক সময় ১৪৯ এমএমসিএফডি উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও কমবেশি ৮৬ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশ সবগুলো গ্যাস ফিল্ড থেকে ২৭০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত উৎপাদন করেছে এখন ২৩’শ এমএমসিএফডির নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদনে বড় ধরনের ধ্বংস নামতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও অনেক ক্ষীণ। দেশীয় উৎস থেকে সামান্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে তা হ্রাসকে সামাল দিতেই হিমশিম খাবে বলে মনে করেন অনেকেই।
তারপরও কেনো নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দিতে পেট্রোবাংলা চুক্তি করতে চাইছে না। কারণ তারা গ্যাস সরবারের নিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছে না। কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়ার চুক্তি করতে পেট্রোবাংলাকে চাপ অব্যাহত রেখেছে। সেগুলো হলো- ইউনাইটেড গ্রুপ, ইউনিক গ্রুপ ও কনফিডেন্স গ্রুপের মতো রাঘব বোয়ালরা। অতীত থেকে ধারণা করা হচ্ছে হয়তো প্রভাবশালীদের চাপে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি হয়েই যাবে। কিন্তু আদৌ কি গ্যাস সরবরাহ হবে, নাকি আগের গুলোর মতোই বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জ তোলার জন্য এমন পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বেসরকারি মালিক যে কোনভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে পারলেই হয়। এরপর গ্যাস দিতে না পারার দায় সরকারের কাঁধে চাপিয়ে বসে বসে ডলার গুণতে থাকবে। যেভাবে এখন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। যে কারণে লাফিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ।
বিপিডিবি জানিয়েছে, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মুসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনেক কাজ হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু সর্বত্র সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকৃত সুফল ঘরে তুলতে পারছে না। দেখা গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে বসে আছে সঞ্চালন লাইন অভাবে (পায়রা) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। আবার লাইন নির্মাণ করে বসে রয়েছে (মাতারবাড়ি) বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোন হদিস নেই।
কয়েক বছরে ধরেই বলা হচ্ছিল সঞ্চালন লাইনের কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কেনো সমন্বয় করা গেলো না। এর দায় কার! দায়ী কাউকে কি কোন শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার নজির নেই।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যেখানেও চরম সিদ্ধান্তহীনতা। একবার উত্তরে ছুটছে, কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো দিক ভুল হয়েছে ঠিক বিপরীত দিকে ছুটা শুরু। প্রথম বলা হলো গ্যাস ফুরিয়ে আসছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা হবে প্রধান উৎস, রিভাইস করে বলা হলো, দেশীয় কয়লা তোলা হবে না, আমদানি নির্ভর কয়লা হবে প্রধান উপজীব্য। যখন কয়লা নিয়ে বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক প্রচারণা, তখন বাংলাদেশ একলাফে কয়লা থেকে বেরিয়ে এলএনজির পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতাকে কখনও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। নাব্যতা সংকটে পায়রায় যখন কয়লা আনতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন মাওয়াতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
ওরিয়ন গ্রুপের ওই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১৬ সালে উৎপাদনে আসার কথা। এখন পর্যন্ত কাজই শুরু করতে পারেনি, এখন এসে কেন্দ্রটি এলএনজিতে রূপান্তরের আবেদন করেছে ওরিয়ন।
বাংলাদেশে ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ ধারণা করা হয়। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরও ৭ টিএসএফ’র মতো। প্রতি বছর প্রায় ১ টিসিএফ’র মতো গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে এতে প্রমাণিত মজুদ ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে শিল্পায়নের গ্যাসের চাহিদাও প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে।
কয়েক বছর ধরেই গ্যাস সংকটের কথা উঠলেই আমদানির কথা বলে আসছে পেট্রোবাংলা। আমদানিকে যেভাবে সামনে আনা হয়েছে বাস্তবতা মোটেই অনুকূলে নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) ১ হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে আর ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়, ২০১৮ সালের আগস্টে প্রথম ইউনিট ৫০০ এমএমসিএফডি আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ইউনিট এসেছে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। সাগর উত্তাল হলেই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। এলএনজি আমদানি বাড়াতে মাতারবাড়িতে ১ হাজার এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখনও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি। অন্যদিকে মাতারবাড়িতে ও পায়রাতে পৃথক দু’টি এফএসআরইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো এখন কাগজে সীমাবদ্ধ। চুক্তির পর ১৮ মাসের অধিক সময় প্রয়োজন পড়বে।
অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির পথ প্রায় বন্ধ। এরসঙ্গে রয়েছে অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার দরের ইস্যু। যার ফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছি।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, ত্রিপুরা তার স্বল্প আয়তনে কূপ খনন করেছে ১৬০টি। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে মাত্র ১১টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ গত ১১০ বছরে মাত্র ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই রয়ে গেছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারেই তা মেনে চলেনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সূফী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমাদের প্রমাণিত রিজার্ভ ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ২ হাজার এমএমসিএফডি আমদানি করতে পারবে। ইউরোপের যে অবস্থা আমরা ওদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবো না। এখনই গ্যাস অনুসন্ধানে ঝাপিয়ে পড়া উচিত। বিশ্ব জ্বালানি পরিস্থিতির কারণে এলএনজি নির্ভর হওয়ার চরম ঝূঁকিপুর্ণ হবে। নিজস্ব ভান্ডারে থাকা কয়লা হতে পারে উপযুক্ত বিকল্প।