গ্যাস চুরি ঠেকাতে জোনভিত্তিক মিটার স্থাপন সম্পন্ন

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে গ্যাস চুরি ঠেকাতে প্রত্যেকটি জোনে মিটার বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। চলতি সপ্তাহ থেকেই এগুলো চালু করা হবে বলে বার্তা২৪.কম-কে নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।

মিটার চালু হলে কোন জোনে সিস্টেম লস কত তা সহজেই নিশ্চিত হওয়া যাবে। এতে করে সংশ্লিষ্ট জোনগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো এবং সিস্টেমলস কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিকভাবে সিস্টেম লস ২ শতাংশের নিচে থাকলে তাকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাস খাতে সিস্টেম লস ১০ শতাংশের উপরে। যদিও কাগজে কলমে গত জুলাই-ডিসেম্বর সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। এই হিসেবের মধ্যে বিশাল ফাঁকি রয়েছে। আবাসিক ও শিল্পে ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে কম সময়ে গ্যাস দিয়েও ২৪ ঘণ্টার বিল আদায়সহ নানাভাবে গরমিল করার অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসেবেও সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রকৃত সিস্টেম লস বাদ দিলে দৈনিক চুরি যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। মাসে প্রায় ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে যার স্পর্ট মার্কেটের এলএনজির মূল্যের (ঘনমিটার ৫০ টাকা আমদানি শুল্কসহ) সঙ্গে তুলনা করলে ৬ শতাংশ গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটিতে। যা বছরে ১ লাখ ৩ হাজার ৫’শ কোটি টাকার মতো।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল গণশুনানিতে বলেছেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়। এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।

এই চুরির পরিমাণটি সরল অংকের হিসেবে। আরেকটি অংক রয়েছে, আবাসিকের মিটারবিহীন ৩৪ লাখ গ্রাহক। মিটার বিহীন গ্রাহকরা মাসে ৪০ ঘনমিটারের নিচে ব্যবহার করলেও প্রতিমাসে একচুলা ও দুই চুলা যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটারের বিল দিয়ে আসছে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় অনেক গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৩ লাখ ৬৮ হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে।

এই চুরির প্রায় পুরোটাই বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধিভুক্ত এলাকায়। কোম্পানিটি চাপের মুখে জোনগুলোকে পৃথক করার উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। সেই কাজ চলছিল ঢিমেতালে। পেট্রোবাংলার বর্তমান চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান যোগদানের পর বিষয়টিতে গতি পায়। এখন চোর ধরা সহজ হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এতে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও তৈরি হবে, নিজের সিস্টেম লস কমিয়ে আনার।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, মিটারগুলো বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন আমরা বুঝতে পারবো কোন অঞ্চলে লোকসান বেশি সেভাবে কর্মসূচি নেওয়া যাবে। সিস্টেম লসের মধ্যে বড় একটি অংক রয়েছে চুরি। আমরা সেই চুরি ঠেকানোর জন্য ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছি। গত অর্থবছরে অবৈধ লাইন ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আমরা মোবাইল কোট পরিচালনা করেছি ৫০০ শতাংশ। অতএব বুঝতেই পারছেন আমরা কিভাবে কাজ করছি।

কবে নাগাদ জোনের মিটারগুলো চালু করা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, আমি নির্দিষ্ট করে তারিখ বলতে চাচ্ছি না, তবে শিগগিরই। আমরা প্রয়োজনের চেয়ে একদিন বেশি সময়ক্ষেপণ করতে চাই না।

সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে পেট্রোবাংলা বলেছিল আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। স্পর্ট মার্কেট থেকে চড়া দরে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তাদের তথ্যে দেখা গেছে গত অর্থবছরে গড়ে দৈনিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। সে হিসেবে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। এ জন্য ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমরা মনে করে চুরি ঠেকানো গেলে স্পর্ট মার্কেট থেকে গ্য্যাস আমদানির প্রয়োজন পড়ে না। তখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর বদলে কমানো যায়। আমরা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছি গ্যাসের দাম ১৬ পয়সা কমানো যায়।

গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। কোম্পানিটির এমন সব দুর্নীতি সামনে এসেছে যা পুরোপুরি অভিনব। বৈধ সংযোগ বন্ধ, তখন সংযোগ দেওয়া হয়েছে, সেসব গ্রাহকের আস্থা সৃষ্টি করার জন্য কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে। যথারীতি গ্রাহকরা বিলও জমা করেন। ২০১২ সালে এ রকম পে-স্লিপের মাধ্যমে ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকা জমা পড়ে। তিতাসের আবাসিক গ্রাহকেরা যেসব ব্যাংকে প্রতি মাসে গ্যাসের বিল জমা দেন, সেই ব্যাংকগুলো থেকে ওই বাড়তি টাকার হিসাব কোম্পানির কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে আসে। কিন্তু এই টাকা তিতাসের হিসাবে জমা হচ্ছিল না (পোস্টিং না হওয়া) তাই বেকায়দায় পড়ে তিতাস। আর তখনেই বিষয়টি সামনে চলে এলে তখন বিষয়টি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

এরপর আরেকটি অভিনব ঘটনা ঘটে, গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার। রাতের আধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার অভিযোগে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করে তিতাস। প্রাথমিকভাবে এক রাতেই ১ হাজার ২৪৭টি সংযোগ বৈধ করে দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলাটি (৭ সেপ্টেম্বর ২০২০) দায়ের করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাসে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। ‍দুদক গ্যাস-সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, অবৈধ সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং করা, কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো।