ফিরোজ খানের খুটির জোর কোথায়!
চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: কে এই ফিরোজ খান, তার খুটির জোর কোথায়! কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে (কেজিডিসিএল) ঘুষ, দুর্নীতি-অনিয়মের রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। হাজারো অভিযোগ উঠলেও তিনি থেকে গেছেন বহাল তবিয়তে।
রাষ্ট্রীয় ওই কোম্পানিটিতে একইসঙ্গে জিএম (প্রশাসন) ও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কোম্পানির সচিব পদে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। যারাই তার দুর্নীতি অনিয়মের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদেরকেই শায়েস্তা করেছেন। তার অপছন্দের কর্মকর্তার পদোন্নতি ঠেকাতে দুদকের নামে ভুয়া চিঠি তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
পেট্রোবাংলার দু’টি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এবং দুদকের তদন্তে রিপোর্টে দুর্নীতির প্রমাণ উঠে এলেও রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পেট্রোবাংলা শুধু দফায় দফায় তদন্ত করেই যাচ্ছেন। অন্যদিকে ফিরোজ খান তার দুর্নীতি সাম্রাজ্য প্রসারিত করে চলেছেন।
কেজিডিসিএল’র দুর্নীতির বিষয়ে সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয় পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ এর নেতৃত্বে। চার সদস্যের ওই কমিটি গঠন করা হয় পরিচালকের (অপারেশন এন্ড মাইন্স) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে। আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আগের কমিটির রিপোর্টের অধিকতর তদন্ত করতে।
আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ কমিটি তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের পাশাপাশি কেজিডিসিএল’এ একটি সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছেন। কমিটি তার ৩১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে বলেছেন, ফিরোজ খান জিএম (প্রশাসন) হিসেবে দীর্ঘ ৭ বছর প্রেষণে কর্মরত থেকে নিয়মবর্হিভূত ও ইচ্ছামাফিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। ফিরোজ খান উক্ত সিন্ডিকেটের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নিম্নোক্ত কার্যাদি সম্পাদন করেছেন।
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিনা অজুহাতে পছন্দ মতো তদন্ত কমিটি গঠন করে বিভাগীয় মামলা দায়েরসহ কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি। কোম্পানিতে যোগ্যতাসম্পন্ন কারিগরি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একই ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, বিভিন্ন বিভাগের দক্ষ কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত মিটার পরীক্ষণ কমিটি বাতিল করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শুধুমাত্র মার্কেটিং বিভাগের চিহ্নিত অসাধু কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি পুর্নগঠন।
পদোন্নতি কমিটির সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ ক্যাডারের সহকারী ব্যবস্থাপকদের পদোন্নতি প্রদান না করা। কারিগরি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে কোম্পানির নির্ধারিত পদোন্নতি কমিটিতে সঠিকভাবে তথ্য উত্থাপন না করা, বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন না করে সুকৌশলে কার্যবিবরণী উপস্থাপন করে চেয়ারম্যানের অনুমোদনসহ অসংখ্য অভিযোগ।
কোম্পানির গেস্ট হাউজে বিনা ভাড়ায় দীর্ঘদিন অবস্থানের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। প্রকৌশলী আমির হামজা ডিজিএম থেকে জিএম পদের প্রমোশনের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেলেও উল্টো তাকে চাকরিচ্যুত করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রকৌশলী আমির হামজাকে পদোন্নতি প্রক্রিয়ার জন্য ২০১৬ সালের ১২ জুলাই পেট্রোবাংলায় প্রেরিত ফাইলে কোন অভিযোগ ছিল না। উক্ত পত্রের প্রেক্ষিতে আগস্টের ২২ তারিখে আমির হামজাসহ ৪ কর্মকর্তাকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে। পদোন্নতি কার্যকরের জন্য কেজিডিসিএল’কে অবহিত করে চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা। ওই চিঠি মোতাবেক ৪ কর্মকর্তার পদোন্নতির ইস্যুটি ৯৯তম বোর্ড সভায় উত্থাপন করা হলে অনুমোদিত হয়। কিন্তু স্বাক্ষরিত কর্যবিবরণীতে পরবর্তী বোর্ডসভায় উপস্থাপনের নির্দেশনা ছিল।
কমিটি আমির হামজার ব্যক্তিগত নথি পর্যলোচনা করে লিখেছে, ৯৯তম বোর্ড সভায় নির্দেশনা পালন না করে আমির হামজাকে কোন ধরণের নোটিশ না দিয়ে সাময়িক বরখাস্তের নথি উপস্থাপন করেন ফিরোজ খান। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তখন হজ্বের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে ছিলেন (৪৭ দিন)। দেশে ফিরে প্রথম কর্মদিবসে ( সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬) কোন রকম নোটিশ প্রদান, জবাববন্দি কিংবা শুনানি গ্রহণ ব্যতিত আমির হামজাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। আমির হামজার বিরুদ্ধে কোন রকম অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অভিযোগ গুরুতর লিখে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়।
৯৯তম বোর্ড সভার নির্দেশনা পালন না করে প্রকৌশলী আমির হামজাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনভিপ্রেত বলে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি।
পেট্রোবাংলার তদন্ত কমিটি বলেছে, সাময়িক বরখাস্তের আদেশে অভিযোগ গুরুতর লিখলেও আদেশের সঙ্গে কোন অভিযোগের অবতারণা করা হয়নি। যেহেতু প্রাপ্ত অভিযোগ গুরুতর উল্লেখ করা হয়েছিল, সেক্ষেত্রে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশের সঙ্গে অভিযোগ থাকা আবশ্যক ছিল বলে মনে করে তদন্ত কমিটি। কিন্তু তা না করে (সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৬) অভিযোগ দায়ের করা পদোন্নতি না দেওয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে বলে কমিটি মনে করে।
কমিটি তার অবজারভেশনে লিখেছে, অর্থ আত্মসাৎ ও জনরোষ ব্যতিত কোন কারণ দর্শানোর নোটিশ/ অভিযোগ গঠন/শুনানি/জবানবন্দি গ্রহণ ছাড়া কাউকেই চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার প্রচলন/নজির নেই।
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, উপব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপক পদের কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুদকের অনাপত্তি পত্র থাকলেও সুপিরিয়র সিলেকশন কমিটির সভা আহ্বানের কয়েকদিন আগে (ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১) স্থানীয় দুদক অফিস থেকে বক্তব্য গ্রহণ ও শ্রবণ করার নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছিল। যার পত্রের অনুলিপি একমাত্র জিএম (প্রশাসন) ফিরোজ খানের নিকট সংরক্ষণ করছেন বলে প্রশাসন বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তারা কমিটিকে অবহিত করে।
দুদকের ওই পত্রটি সম্পর্কে তদন্ত কমিটি লিখেছে, পত্রটি স্মারক নম্বরবিহীন এবং কোম্পানি পর্যায়ে পত্রটি গ্রহণের কোন রেকর্ড নেই। এতে প্রতীয়মান হয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করার জন্য এ ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত পত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা ফিরোজ খান ২০১৬ সালে প্রেষণে নিয়োগ পান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে। ৩১ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে পড়তে পড়তে দুর্নীতি অনিয়মের তথ্য উপাত্ত উঠে এসেছে। পূর্বের কমিটিও ৯টি বিষয়ে তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে। কিন্তু এতোকিছুর পরও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো দূরের কথা, বদলি কিংবা দায়িত্ব থেকে সরানো হয়নি। সে কারণে প্রশ্ন উঠেছে কে এই ফিরোজ খান, তার খুটির জোর কোথায়?
ফিরোজ খানকে একাধিক দফায় ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পর পর কয়েকদিন এসএমএস দিলেও রিপ্লাই দেননি। বক্তব্যের জন্য গত ১১ সেপ্টেম্বর বেলা ১২টায় তার কার্যালয়ে গেলেও সাক্ষাৎ দেননি। প্রথমে তার সহকারী বলেন, স্যার অফিসে রয়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সাক্ষাৎ চাইলে বসতে বলেন। মিনিট দশেক পরে বলেন স্যার রুমে নেই।
পে্ট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) মো. আলতাফ হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক করণীয় গ্রহণ করা হয়েছে। আপাতত এর বেশি বলতে পারবো না। সময় হলেই সবকিছু জানানো হবে।
কি ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সে প্রশ্নের দিতে রাজি হননি পরিচালক (প্রশাসন)।