মহাজালিয়াতির পরও বহাল তবিয়তে জিএম সফিউল আজম 

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মহাজালিয়াতির পরও বহাল তবিয়তে জিএম সফিউল আজম 

মহাজালিয়াতির পরও বহাল তবিয়তে জিএম সফিউল আজম 

চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা জিএম সফিউল আজম এখনও বহাল তবিয়তে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ।

বোর্ডের অনুমোদনের আগেই সংযোগ প্রদান, জালিয়াতির জন্য ডেসপাচ রেজিস্টারের পাতা (পাতা-৫৫৭) ছিড়ে ফেলা এবং মিটার টেম্পারিংয়ের মতো ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ। এতো এতো জালিয়াতির তথ্য প্রমান সামনে এলেও বছরের পর বছর ধরে শুধুই তদন্তের পর তদন্ত চলছে। আর সিন্ডিকেট হয়ে উঠেছে আরও অপ্রতিরোধ্য।

বিজ্ঞাপন

মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত শিল্প-৫১৫১) আবেদন করেন ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ১ দিন পরেই (২০ ডিসেম্বর) ওই সংযোগটি প্রদান করা হয়। এতে সব ধরনের আইনকানুন উপেক্ষা করা হয়েছে। সংযোগটিও প্রদান করা হয়েছে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ক্যাপটিভে। যে ক্যাভটিভ বন্ধে বিদ্যুৎ বিভাগ নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড ৯০০ কিলোওয়ার্ট ক্ষমতার ক্যাপটিভের আবেদনটি বোর্ডে তোলার বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই বিধিনিষেধ অমান্য করে মোটা অংকের বিনিময়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটির বিদ্যামান ক্যাপটিভ পাওয়ারের মিটার পরীক্ষা করে ১৩.৭৫ শতাংশ (২০২১ সালের ২৩ জুন)  ধীরগতি পাওয়া যায়। কোন মিটারে সমস্যা পাওয়া গেলে, অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করার আইনী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবৈধ হস্তক্ষেপ পাওয়া গেলে জরিমানা আর যান্ত্রিক ত্রুটি হলে পুর্ববর্তী ৬ মাসের গড় বিল সমন্বয় করতে হয়। কিন্তু ওই গ্রাহকের ক্ষেত্রে কোন কিছুই করা হয় নি উৎকোচের বিনিময়ে।

বিজ্ঞাপন

৫ কোটি ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বকেয়ার কারণে মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্সের একটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নিয়ম রয়েছে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা কিস্তিতে আদায়ের শর্তে পুনঃসংযোগ দিতে পারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিন্তু কোন টাকা আদায় না করেই শুধুমাত্র পুনঃসংযোগ ফি ৪০ হাজার টাকা আদায় সাপেক্ষে সংযোগ প্রদানের ফাইল উপস্থাপন করেন মহাব্যবস্থাপক  সফিউল আজম। এখানেও রড় রকমের বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছে, মিটারে নেগেটিভ এরোর ছিল। এরপরও গ্যাস বিপণন নীতিমালা অনুযায়ী বিল সমন্বয়/জরিমানাসহ বকেয়া আদায় না করে পুনঃসংযোগ প্রদান করায় কেজিডিসিএল এর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্নের ৬ মাস পর শুধুমাত্র মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মিটার পরীক্ষা করায় গ্রাহক কর্তৃক অবৈধ হস্তক্ষেপের আলামত নষ্ট হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে।

মেসার্স ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডে (গ্রাহক সংকেত ৮০৬৫) সংযোগ প্রদানে অভিনব জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পূর্বে একবার সংযোগের আবেদন করলে বোর্ডসভা (২০২০ সালের ২২ নভেম্বর) বাতিল করেছিলেন। বিষয়টি জানার পরও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ডায়মন্ড সিমেন্টকে সংযোগ প্রদান করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন সফিউল আজম খান।

মেসার্স সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড (সাদ মুছা গ্রুপ) নতুন সংযোগের আবেদনেও জালিয়াতির ঘটনা উন্মোচন হয়েছে। পর্ষদের সভার পূর্বেই ওই গ্রাহক চাহিদাপত্র ইস্যু করেছেন সফিউল আজম খান। ওই জালিয়াতি সামনে চলে এলে ধামাচাপা দিয়ে ডেসপাচ রেজিস্টারের পাতা (পাতা-৫৫৭) পরিবর্তন করা হয় সফিউল আজম চক্র।

পর্ষদ সভায় মেসার্স আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের (গ্রাহক সংকেত-৭৩৭৮) সংযোগের অনিয়মের বিষয়ে উত্থাপন করেন একজন সদস্য। পর্ষদের অনুমোদনের পূর্বে ডিমান্ড নোট ইস্যু করার বিষয়ে যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়। পর্ষদের আলোচনা অনুযায়ী তদন্ত করা হয়নি, এমনকি পরের সভায় উপস্থাপন না করেই সংযোগ প্রদান করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি তার মতামতে উল্লেখ করেছেন, ডেসপাচ রেজিস্ট্রারের পাতা পরিবর্তন করে আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের পরিবর্তে জালালাবাদ সিএনজির ভূয়া এন্ট্রি বসানোর জন্য সফিউল আজম খান দায়ী।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সফিউল আজম খানের অফিসে গেলে তিনি সাক্ষাৎ দেন নি। ফোন দিলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর বলেন, কোন কথা থাকলে প্রশাসন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেন। আমার কোন বক্তব্য নেই। বলেই লাইন কেটে দেন। এরপর কয়েক দফায় এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি। হোয়ার্টসঅ্যাপে ম্যাসেস দিলে সিন করেছেন, কিন্তু কোন রিপ্লাই দেন নি।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা কেজিডিসিএল’র তদন্ত কমিটি নানা রকম পুকুরচুরির ঘটনায় চাঞ্চল্যকর সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ, কোম্পানি সচিব ফিরোজ খান, সফিউল আজম খানের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেটের তথ্য প্রমান পেয়েছে পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটি। কোম্পানিটিতে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও তাদের দায়িত্ব না দিয়ে সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকে পদোন্নতির জন্য নির্বাচিত হলেও তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয় নি। পদোন্নতি ঠেকাতে দুদকের একটি বেনামী চিঠি সামনে আনা হয়। পরে সেই চিঠি স্মারকবিহীন ভূয়া বলে জানা গেছে। আবার সিলেকশন কমিটি পদোন্নতির সুপারিশ দিয়েছে, বোর্ড সেই ‍সুপারিশ অনুমোদন দিয়েছে। সেই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে কোন রকম শোকজ নোটিশ ছাড়াই।

কর্ণফূলী গ্যাসের এসব পুকুরচুরি ঘটনায় দফায় দফায় তদন্ত করা হয়। সর্বশেষ কমিটি ( আলী ইকবাল নরুল্লাহ) সুনির্দিষ্ট অনিয়মের তথ্য প্রমান ও সুপারিশ তুলে ধরে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। সময়ক্ষেপন করতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় সেই তদন্ত রিপোর্ট। মন্ত্রণালয় থেকে ১৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এতে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি বিভাগের প্রতি এক ধরণের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে জনমনে। সৎ অফিসাররা হতাশ হচ্ছেন।

পে্ট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ আলতাফ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক করণীয় গ্রহণ করা হয়েছে। আপাতত এর বেশি বলতে পারবো না। কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সময় হলেই সবকিছু জানানো হবে।

পেট্রোবাংলার অপর একজন পদস্থ কর্মকর্তা এম এ মাজেদসহ দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তাকে শোকজ করার কথা নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি তার নাম প্রকাশ করতে আপত্তি জানিয়েছেন।