তিতাস গ্যাসের ঘুষ বাণিজ্যে অসহায় গ্রাহকরা
ক্যাপটিভ পাওয়ার ১০ মেগাওয়াটের বেশি হলে গ্যাস সংযোগ দিতে বিদ্যুৎ বিভাগের পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারপরও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) এমডির বিরুদ্ধে।
গ্যাস সংকটের কারণে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস বসে থাকছে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে ২৩ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২২৫২ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে গত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৯৭৩.৭ এমএমসিএফডি। সরবরাহ ঘাটতি থাকায় বেশিরভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থেকেছে। কোথাও কোথাও আংশিক উৎপাদন হয়েছে।
গ্যাস সংকটে কারণে ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ না দিতে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোম্পানি তিতাস গ্যাস সেই নির্দেশনাকে তোয়াক্কাই করছে না। কোন রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেদারছে সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। নারায়নগঞ্জের চৈতি কম্পোজিট টেক্সটাইল ১২.৯৩ মেগাওয়াট, টঙ্গীর স্কাই বিডি লিমিটেড ১২.২৫ মেগাওয়াট, মুন্সীগঞ্জের প্রিমিয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে ১২.৫১ মেগাওয়াটের নতুন ক্যাপটিভের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মতিন স্পিনিং মিলের লোড বাড়িয়ে ২২.০৪ মেগাওয়াট করা হয়েছে।
১০ মেগাওয়াটের বেশি ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দিতে বিদ্যুৎ বিভাগের পূর্বানুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই বাধ্যবাধকতা এড়াতে একই শিল্প কারখানায় পৃথক আইডি দিয়ে সংযোগ প্রদানের তথ্য পাওয়া গেছে। ভালুকার জামিরদিয়ায় অবস্থিত এনআর গ্রুপের কারখানায় পৃথক আইডি দিয়ে সংযোগ প্রদানের তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি এনআর গ্রুপকে ভিন্ন তিনটি গ্রাহক সংকেত দিয়ে ২৪.৯২ মেগাওয়াট ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দিয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)। এনআরজি স্পিনিং মিলসের নামে ১৬.২৫ মেগাওয়াট, এনআরজি কম্পোজিট ইয়ার্ন ডাইন ৩.৮৭ মেগাওয়াট, এনআরজি নিট কম্পোজিট ৪.৮০ মেগাওয়াট। সবগুলোর ঠিকানা একই, অর্থাৎ ভিন্ন নাম ব্যবহার করে ওই জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এতে তিতাসের যোগসাজস দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনআরজি কম্পোজিট ইয়ার্ন ডাইন ৩.৮৭ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি করে ১১.৯৪ মেগাওয়াট, এনআরজি নিট কম্পোজিট ৪.৮০মেগাওয়াট থেকে বর্ধিত করে ৬.২০ মেগাওয়াটের অনুমোদন দিতে কারচুরির অভিযোগ উঠেছে। একই কম্পাউন্ডে এনআরজি হোমটেক্স নামে আরেকটি নতুন (৭.৭৮ মেগাওয়াট) সংযোগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
গত ২১ জুলাই তারিখের বোর্ডসভায় জামিরদিয়া এলাকায় অবস্থিত মেসার্স স্কয়ার এ্যাপারেলস লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত নম্বর-৩৭৯/৮৭৯০১২৬) এর ক্যাপটিভ রানে ৪৭ হাজার ৮৮৯ ঘনফুট (ঘণ্টা প্রতি) লোড বৃদ্ধি করা হয়। একই বোর্ডে মেসার্স বি. জে.বেড উইভিং লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত নম্বর ৩২২/৮৩২-০০০৯৮০) ক্যাপটিভ লোড বাড়ানো হয়। শুধু লোড বৃদ্ধি নয় গত ২৬ এপ্রিলে বোর্ডে সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কো. লিমিটেড ও মেসার্স সাচ্ছান কোম্পানির (বিডি) নতুন ক্যাপটিভ সংযোগ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে ৯ এপ্রিল ৮৮১ তম বোর্ডসভায় প্রায় ১৬টি ক্যাপটিভ সংযোগ পুনঃবিন্যাস করা হয়। শুধু এসব বোর্ডে নয়, প্রত্যেক মাসেই ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দিয়ে নতুন নজীর গড়েছেন বর্তমান এমডি। এসব সংযোগের পেছনে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তিতাস গ্যাস ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বিরুদ্ধে।
তিতাস তাদের বিদ্যমান গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধসহ নানাভাবে রেশনিং করতে হচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে নতুন নতুন ক্যাপটিভ সংযোগের নামে এই বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
ক্যাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখন আর অদক্ষ ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া উচিত না। জাতীয় স্বার্থে এসব ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এখানে অসাধু ব্যক্তি স্বার্থ কাজ করছে। এতে করে কেউ কেউ বিশেষভাবে লাভবান হয়ে থাকার অভিযোগ অমুলক নয়।
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি।
হারুনুর রশীদ মোল্লাহ চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর তিতাসের সেবার মান তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়েনা এটা এখন ওপেন সিক্রেট। মিটার নষ্টের অভিযোগ দিলে দেখা মেলে ৬ মাস পর, আর সেই মিটার পরীক্ষা করতে বছর কেটে যাওয়ার অহরহ প্রমান রয়েছে।
শিল্পের বয়লার এবং জেনারেটর পরিবর্তন করতে হলে, তিতাসের পূর্বানুমতি আবশ্যক। কোটি কোটি টাকা খরচ করে গ্যাস সাশ্রয়ী বয়লার এনে বসে থাকলেও তা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। জোনাল অফিস থেকেই শুরু করতে হয় ঘুষ প্রদান, প্রত্যেক টেবিলেই ঘুষ দিয়ে দিয়ে উপরে তুলতে হয় না দিলেই থমকে যায় ফাইল। এ রকম শতাধিক আবেদন এখনও বিভিন্ন জোনাল অফিসে পড়ে রয়েছে।
একজন শিল্প মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, কয়েক কোটি টাকা খরচ করে জেনারেটর ও বয়লার এনেছি। এরপর ২০২০ সালে আবেদন করে বসে আছি তিতাস অনুমোদন দিচ্ছে না। মেশিনগুলো পড়ে থেকেই গ্যারান্টি ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনুমোদন দিতে আরও দেরি করলে, মেশিনগুলো যদি চালু না হয় তার দায় কে নেবে। ব্যাংক কি আমার ঋণের টাকা মওকুফ করবে। নতুন বয়লার ও জেনারেটর বসানো গেলে আমারও যেমন বিল কম আসবে, তেমনি আমদানি করা চড়ামূল্যের গ্যাসও সাশ্রয় হবে। আমার মতো অনেকেই মেশিন এনে বসে রয়েছে অনুমোদন পাচ্ছে না। অথচ সরকার বারবার গ্যাস সাশ্রয়ী মেশিন ব্যবহার করতে উৎসাহ দিচ্ছে।