পদে পদে দুর্নীতি করেও অধরা আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ!

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পদে পদে দুর্নীতি করেও অধরা আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ

পদে পদে দুর্নীতি করেও অধরা আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ

কনডেনসেট পাচারসহ পদে পদে দুর্নীতি করেও অধরা পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ। অদূশ্য শক্তির আর্শিবাদে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন পদোন্নতি।

আরপিজিসিএল’র মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ। জ্যেষ্ঠতা তালিকায় তার অবস্থান ছিল ৩৪ তম, কিন্তু ৩৩জন জ্যেষ্ঠকর্মকর্তাকে ডিঙ্গিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের চলতি দায়িত্ব বাগিয়ে নেন। কথিত রয়েছেপেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান রুহুল আমিনের উত্তরা মডেল টাউনের বাড়ি নির্মাণেআর্থিকভাবে সহযোগিতা করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ বাগিয়ে নেন। নিয়োগ পেয়েপদোন্নতি ও নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারী বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ করেঅবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেন।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালে মহাব্যবস্থাপকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তাকে প্রমোশন দেওয়া হয়। যোগ্যতা মূল্যায়নে উর্ত্তীর্ণ হওয়া জ্যেষ্ঠ ২জন মহাব্যবস্থাপক ছিলেন মীর আবদুলহান্নান ও মো. ফজলুর রহমান। তাদেরকে বাদ দিয়ে রহস্যজনক কারণে ঊর্ধ্বতনমহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তী ধাপেও অন্যদের ডিঙ্গিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে পেট্রোবাংলার নীতি-নির্ধারণীমূলকপরিচালক (পরিকল্পনা) পদের চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। পেট্রোবাংলা এবং এরআওতাধীন কোম্পানীসমূহের ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদধারীকর্মকর্তাদের সম্মিলিত জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পেট্রোবাংলার পরিচালক পদে নিয়োগ, পদোন্নতিপ্রদান করার কথা। পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রদানের জন্য ফিডার পদধারী অর্থাৎপরিচালক পদের একধাপ নীচের পদধারী কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওবিবেচনাযোগ্য মাপকাঠি। কিন্তু ১ম ও ২য় জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা পেট্রোবাংলার অধীনপশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড (পিজিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.আবদুল মান্নান পাটওয়ারী এবং বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড(বিজিডিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শঙ্কর মজুমদার। তাদেরকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণনিয়মনীতি ভঙ্গ করে ঘুষের বিনিময়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) পদেরপদোন্নতির  সুপারিশ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকারসময় রশিদপুর কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্টে (২০১৮-১৯ অর্থবছরে) কনডেনসেট মজুদেঘাটতি ধরা পড়ে। রশিদপুর কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্টে কনডেনসেট ঘাটতির পরিমাণ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬১ লিটার। তৎকালীন বাজার দর অনুযায়ী ন্যূনতম বাজার মূল্যছিল ৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা (প্রতি লিটার ৩৬.৯৩ টাকা)। রশিদপুর ৪০০০ ব্যারেলকনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্টেও কনডেনসেট পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। ওই প্লান্টটিতে১৩ লাখ ৫২ হাজার ৯২৬ লিটার ঘাটতি পাওয়া যায় পরীক্ষার সময়। যার তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা।

কনডেনসেট ঘাটতির বিষয়টি এসজিএফএল এর সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোম্পানিরতৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহকে মৌখিকভাবে জানানোহয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তার অনুগতকর্মকর্তারা কনডেনসেট ঘাটতির বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বিপুলপরিমাণ কনডেনসেট অবৈধভাবে বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়। এসজিএ্ফএল’র সাবেকমহাব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) ইকরামুল কবির ১২ কোটি টাকার তেল আত্মসাতের বিরূদ্ধেএকটি অভিযোগপত্র সরাসরি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বরাবরে দাখিল করেন। রহস্যজনক কারণে সেই রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখতে পায় নি।

আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ আরপিজিসিএল’র ম্যানেজার পদে থাকাকালীন ব্যবস্থাপনাপরিচালক  এবিএম ফজলে এলাহী ও পরিচালক শফিউল আজমের সঙ্গে যোগসাজস করে৭০০ কোটি টাকার তেল চুরি ঘটনা ঘটে। তেল চুরির অভিযোগের  প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমনকমিশন (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্ত করে। তদন্ত শেষে দুদক চার্জশীট দাখিল করা হয় (দুদক-এর স্মারক নম্বর-দুদক/সি/১৫/২০০৮/অনু: ও তদন্ত-২/সিলেট/১৭৯৮৭ তারিখ: ০৫-০৭-২০১২) ।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)-এরব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার সময়ে তার বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।  মেসার্সপ্যারাগণ টেক্সটাইল ছিল টিজিটিডিসিএল-এর একটি বিলুপ্ত শিল্প গ্রাহক। বিলুপ্ত গ্রাহককেগ্যাস বিপণন নীতিমালা-২০১৪ মোতাবেক গ্যাস পুনঃসংযোগ প্রদানের কোন সুযোগ নেই।অথচ বিপণন বিভাগের আপত্তি থাকা সত্বেও ধার্যকৃত অতিরিক্ত বিল, জরিমানা, মিটারেরমূল্য, বকেয়া গ্যাস বিল ও অন্যান্য বকেয়া ইত্যাদি আদায় না করেই সংযোগ দেন তিনি। বৈধপাওনা (বকেয়া গ্যাস বিল, জরিমানা, মিটারের মূল্য ইত্যাদি) আদায় না করায় রাষ্ট্রীয়মালিকানাধীন কোম্পানি তিতাস গ্যাস বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) কর্তৃক দৈনিক ৪০০০ ব্যারেল ক্ষমতাসম্পন্নকনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্ট স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তারবিরুদ্ধে। ইপিসি ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করতে ব্যর্থ হয়। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়ায় এসজিএফএল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারের নিকটহতে প্রায় ৪৩  কোটি টাকা এলডি কর্তন করে। কর্তনকৃত উক্ত টাকা এসজিএফএল-এর আয় ধরে কোম্পানির বাৎসরিক হিসাব তৈরী করা হয়। ওই হিসাব কোম্পানির বোর্ড সভা ও কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুমোদিত হয়। ওই আয়ের ভিত্তি করে এসজিএফএলসরকারকে ১০ কোটি টাকা ট্যাক্স প্রদান করে। এসজিএফএল-এর নিজস্ব আয় হিসেবে গণ্যকরা এই অর্থ ঠিকাদারকে ফেরৎ প্রদানের জন্য আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ কোম্পানীরমহাব্যবস্থাপক প্রদীপ বাবুকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন এবং কমিটিকে চাপ প্রয়োগ করেকর্তনকৃত এলডি-এর ৪০ (চল্লিশ) কোটি টাকা ঠিকাদারকে ফেরত প্রদানে বাধ্য করেন। এখন তা কোম্পানি বোর্ডের অনুমোদন গ্রহণের তদবির  চালিয়ে যাচ্ছেন। রহস্যজনককারণে কোম্পানির স্বার্থ না দেখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে উঠে পড়ে লেগেছেন।

রশিদপুর দৈনিক ৪০০০ ব্যারেল ক্ষমতাসম্পন্ন কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্ট স্থাপন (১মসংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক (পত্রনম্বর:০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.০৩০.১৯-৭২৬৮) তদন্ত করার নির্দেশ দেয়। তদপ্রেক্ষিতেপেট্রোবাংলার কর্তৃক অফিস আদেশে (নম্বর: ২৮.০২.০০০০.০১১.৩৭. ০৫১.১৯.৬৮০) ৩জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আলীইকবাল মো. নূরুল্লাহ দায়ী হওয়া সত্বেও পেট্রোবাংলায় ঘুষ দিয়ে রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়েরাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রশিদপুর দৈনিক ৪০০০ ব্যারেল ক্ষমতাসম্পন্ন কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লাট স্থাপন প্রকল্পেজেনারেটর ব্র্যান্ড পরিবর্তন, স্টোরেজ ট্যাংক স্থাপনে ডিজাইন পরিবর্তন ইপিসি ঠিকাদারকর্তৃক দাখিলকৃত দরপত্র প্রস্তাব পরিবর্তন করে ঠিকাদার থেকে বিশেষ সুবিধা গ্রহণ, নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে ঘুষের বিনিময়ে একাধিক সিএনজি ফিলিং স্টেশন-এর অনুমতি প্রদান।

প্রকৌ. আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ এর দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে গ্যাস সেক্টরেশৃঙ্খলা ও কর্মপরিবেশ বর্তমানে ভেঙ্গে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপকর্ম, অন্যায় ও দুর্নীতিরমাধ্যমে অবৈধ  অঢেল সম্পদ ও প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন। তার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনায় সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা চান কাজ ও দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন। পেট্রোবাংলার এসব অনিয়ম ও বৈষম্যের কারণে অনেকেই পেট্রোবাংলা ও তার অধীনস্থ কোম্পানিগুলো ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এতে করে দক্ষ জনবল হারাচ্ছে রাষ্ট্র।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ।