খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানির অনুমোদন

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সাত মাস পর আবার খোলা বাজার থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। প্রথম ধাপে এক কার্গো (৬১ হাজার ৫০০ মে. টন) এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে এলএনজি ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল দেশের বাইরে থাকায় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে ওই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞাপন

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, প্রতি ইউনিট এলএনজি দাম পড়বে প্রায় ১৯ দশমিক ৭৮ মার্কিন ডলারের মতো। খোলা বাজার থেকে কেনা এলএনজির ওই কার্গোটি ফেব্রয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে দেশে এসে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে ফরাসি কোম্পানি টোটাল গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার বিজনেস সার্ভিসেস।

দেশীয় গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাসের চাহিদা পুরণ করতে না পারায় ২০১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথমে কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানি করা হতো। ২০১৯ সালে মোট ৬৩ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়। পরের বছর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে খোলাবাজার থেকেও এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়। তখন ৬ থেকে ৭ ডলার মিলত প্রতি ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সেই এলএনজির দাম ৬২ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের আগস্টে খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

এতে করে গ্যাসের সংকট চরম আকার ধারণ করে। ব্যবসায়ী নেতারা দাম বাড়িয়ে দিয়ে হলেও নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবি জানান। তাদের সেই দাবির প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত ১৮ জানুয়ারি দেওয়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার ৮.৯৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা, ক্যাপটিভে ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, বৃহৎ শিল্পে ১৮.০২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, বাণিজ্যিক হোটেল ৩.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০.৫০ টাকা করা হয়। তারপরেই সরকার খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানির পথে পা বাড়াল।

এর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের (এলএনজি) দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি। তখন সার উৎপাদনে ২৫৯ শতাংশ, শিল্পে ১১.৯৬ শতাংশ, বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। আবাসিকে একচুলার দর ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হয়। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেছেন, বছরে ৮০টি কার্গো হ্যান্ডেলিং করার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। এরমধ্যে ৫৬টি কার্গো আসছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। আর খোলা বাজার থেকে ২৪টি কার্গো আনার সুযোগ রয়েছে। সবগুলো আনতে পারলে অনেক সুবিধা হতো। তবে বর্তমানে যে দর রয়েছে তাতে ২৪ কার্গো আনা কঠিন। আমাদের জন্য একটি সুখবর রয়েছে দাম কমতির দিকে রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এলএনজি আমদানির বিষয়ে একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছি। সেখানে তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররা দরপ্রস্তাব দেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাছাই করা হয়।

গত সেপ্টেম্বর মাসে পেট্রোবাংলার একটি টিম কাতার সফর করে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি বাড়ানোর জন্য। কাতার থেকে ফিরে পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেছিলেন, কাতার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন দিচ্ছে। কাতারের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে ১ দমমিক ৮ মিলিয়ন টনের নিচে হবে না, আবার ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টনের উপরে যাবে না। বিশ্বব্যাপী এলএনজি চাহিদা ও দাম ঊর্ধ্বমুখীর মধ্যেও কাতার সর্বোচ্চ পরিমাণে সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। আমরা তাদের কাছে সরবরাহ বৃদ্ধির আরও প্রস্তাব দিলে সায় পাওয়া গেছে। ২০২৫ সাল থেকে বর্ধিত এলএনজি সরবরাহ করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তবে কি পরিমাণ দিতে পারবে সে বিষয়ে এখনই কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এছাড়া ওমান থেকে বছরে ১ মিলিয়ন টন আমদানি করা হচ্ছে।

গ্যাস সংকটে বেহাল দেশের অর্থনীতি, বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ, শিল্প বাণিজ্যেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। রেশনিং করেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না পরিস্থিতি। সকলের একই প্রশ্ন কবে নাগাদ স্বস্তি মিলবে! সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে কিছুই বলা হচ্ছে না। বাস্তবতা বলছে পরিস্থিতি উন্নতি নয়, আরও চরম অবনতি হতে পারে। বিশেষ করে আসছে গ্রীষ্মে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন অনেকেই। কারণ দেশীয় গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন ব্যাপক আকারে হ্রাস পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বর্তমানে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে দৈনিক কমবেশি ২৩’শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এরমধ্যে আমেরিকান কোম্পানির মালিকানাধীন বিবিয়ানা ফিল্ড থেকেই আসছে ১২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি উৎপাদন হচ্ছে ওই একটি গ্যাস ফিল্ডেই। সেখানে প্রতি নিয়তই উৎপাদন কমে আসছে।

বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতাই এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার ছাড়া আরও কোন সরকারেই যথাযথ মনযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার সামগ্রিক ফল আজকের জ্বালানি সংকট।

বঙ্গবন্ধু সরকার তার সাড়ে ৩ বছর সময়ে ৯টি কূপ খনন করেছিলেন। এর মধ্যে অফসোরে (সাগরে) ৭টি, মূল ভূ-খণ্ডে ছিল ২টি। বঙ্গবন্ধু সরকারের পরের ৩৬ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে মাত্র ১২টি। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মাত্র ২টি কূপ খনন করেছিল বিএনপি ও তত্বাবধায়ক সরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৪১টি কূপের মধ্যে বর্তমান সরকারের ১৩ বছরে ২১টি কূপ খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যদিও এই পরিসংখ্যানও স্বস্তিদায়ক নয়। জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুসরণ করা গেলে ৫২টি অনুসন্ধান কূপ খনন হওয়ার কথা।