প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন তিতাস গ্যাস এমডি!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠি

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠি

সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডে (গাজীপুর) গ্যাস সংযোগে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙানোর দায়ে ফেঁসে যেতে পারেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ।

সিলভার নিট কম্পোজিটের নতুন গ্যাস সংযোগে আবেদনের ওপর তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ লিখেছেন, মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত আলাপ করবেন। যেহেতু বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধানমন্ত্রীকেই ইঙ্গিত করেছেন। যথারীতি ওই নোটের প্রেক্ষিতে গ্যাস সংযোগটি প্রদান করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আর এই বিষয়টি নজরে আসায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তদন্তের নির্দেশনা নয়, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে বলা হয়েছে।


গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রেরিত ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন পরিচালক-১১ রুপালী মন্ডল। চিঠির ‘বিষয়: বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ করত: শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানাবিধ অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

চিঠিতে বলা হয়েছে, উল্লেখিত বিষয়ে সূত্রোস্থ পত্র ও সংযুক্তিসমুহের ছায়ালিপি এতদসঙ্গে পেরণ করা হলো। পত্রে বর্ণিত বিষয়াদি পরীক্ষান্তে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েকে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবরে আ. লতিফ কর্তৃক স্বব্যাখ্যাত অভিযোগ পত্র।

খনিজ সম্পদ বিভাগ ওই নির্দেশনার পাওয়ার পর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে অভিযোগ তদন্তপূর্বক এক মাসের মধ্যে মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য বলা হয়েছে। সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে একটি অভিযোগপত্র, কয়েকটি চেকের ফটোকপিসহ ৪০টি পৃষ্ঠার একটি নথি।

ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, সিলভার নিট কম্পোজিট নামক একটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনে লিখিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত আলাপ করবেন। আবেদনে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শেখ হাসিনা, কিংবা প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দফতরের কারো কোন স্বাক্ষর কিংবা সুপারিশ নেই। শুধুমাত্র উৎকোচ গ্রহণ করে নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে প্রায় ৬ মাসের পুরনো একটি আবেদন সংযুক্ত করে দু’টি প্রতিষ্ঠানের ফাইল দ্রুততার সঙ্গে পাস করিয়ে নেওয়া হয়। জ্বালানি খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের মতো জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর রেফারেন্স ব্যবহার করে অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি দু’টি নথি পাস করিয়ে নিয়েছেন।

ওই নোটসহ অগ্রগামী করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর জায়গার রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে, অথচ সেই রেফারেন্স কোন যাচাই-বাছাই না করেই অনুমোদন দেওয়াকে পুরো যোগসাজস মনে করছেন অনেকেই।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়

অভিযোগে, তিতাস গ্যাসের আরও নানা রকম অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমান এমডি যোগদান করার পর থেকে সিস্টেম লস বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সিস্টেম লস ছিল, এখন সেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সিস্টেম লস ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হবে। ৫৮ বছরের ইতিহাসে তিতাস গ্যাস এবারই প্রথম লোকসানের স্বীকার হয়েছে। হারুনুর রশীদ মোল্লাহ যোগদানের পূর্বে তিতাসের ক্রমপুঁঞ্জিভূত বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা, এখন সেই বকেয়া ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যতীত (এমডি মালিক পক্ষ হিসেবে বিবেচিত) সকল কর্মচারীগণ প্রফিট বোনাস ৫ শতাংশ অর্থ সমহারে পাবেন। অথচ বর্তমান এমডি লভ্যাংশের অর্থ নিয়মিত গ্রহণ করছেন। ওই টাকা তার ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে গ্রহণ করেন না। কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে চেক ইস্যু করে নগদ টাকা গ্রহণ করে থাকেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি চেকের ফটোকপি জুড়ে দেওয়া হয়েছে অভিযোগপত্রে।

বর্তমানে গ্যাস সংযোগ সংক্রান্ত ৩ শতাধিক কোম্পানির আবেদন ঝুঁলে থাকলেও বেছে বেছে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে ঠিকাদার জিসান পাটোয়ারীর নাম। তার কাছে গেলেই সংযোগ নিশ্চিত। এমনকি ৩ দিনের গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করার অনেক নজির সৃষ্টি রয়েছে। বহুল আলোচিত আলী এন্টারপ্রাইজের ওই ঠিকাদারের সঙ্গে এমডির দহরম-মহরম চোখে পড়ার মতো। তার সঙ্গে প্রায় প্রত্যেক কার্যদিবসে রূদ্ধদ্বার বৈঠক করেন এমডি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পর এমডির কক্ষে ওই বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সে সময়ে এমডির কক্ষে কারো প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। এছাড়া আউটসোর্সিংয়ে লোকবল নিয়োগে দুর্নীতি, একাধিক গাড়ির অপব্যবহারসহ অনেকগুলো অভিযোগ আনা হয়েছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তদন্তের নির্দেশ সংক্রান্ত চিঠি পেট্রোবাংলায় পৌঁছার তথ্য নিশ্চিত করেছেন পরিচালক (প্রশাসন) আলতাফ হোসেন। এর বেশি কোন তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বার্তা২৪কম-কে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

তিনি বলেন, আমাকে চেয়ার থেকে সরাতে একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা নানা রকম মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙানোর প্রশ্নই আসে না। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় একটি গ্রুপ নাখোশ হয়েছে। তারাই ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে।

প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ ২০২১ সালে প্রথম এক বছরের চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ পান। চুক্তির মেয়ার শেষ হলে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দেড় মাস আগেই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তাকে আবারও এক বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে গ্যাস সংযোগ, তদন্তের নির্দেশ