পড়েই থাকছে রশিদপুর-৯ নম্বর কূপের গ্যাস
বন বিভাগের অনুমতি না পাওয়ায় ঝুলে গেছে রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের ৯ নম্বর কূপের গ্যাস উৎপাদন। এতদিন চিঠি দিয়ে হাত গুটিয়ে ছিল সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফসিএল)।
পাইপলাইন স্থাপনে বনের গাছ কাটার জন্য চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে বন বিভাগ একটি কমিটি গঠন করে, তারা রিপোর্ট দিলেও এখনো সুরাহা হয়নি বিষয়টি। যে কারণে ঝুলে রয়েছে কূপটি থেকে গ্যাস উত্তোলন প্রক্রিয়া। কুপটি থেকে দৈনিক ১৪-১৯ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। শুধুমাত্র বিদ্যমান পাইপলাইনের সঙ্গে হুকিং করে দিলেই গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সেই কাজটি না করে ৫ বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে কূপটি।
তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নতুন সচিব মো. নুরুল আলম বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। সম্প্রতি বন বিভাগের সচিবের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। বিষয়টি দ্রুত সমাধান করার তাগিদ দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পাইপলাইন নেই কারণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না এই কথা বলে ৫ বছর ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে রশিদপুরের ওই কূপটি। রশিদপুর-৭ নম্বর কূপ পর্যন্ত পূর্বের যে লাইনটি রয়েছে সেটি ব্যবহার অনুপযোগী। যে কারণে ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় এসজিএফসিএল। বার্তা২৪.কম এ একাধিক রিপোর্ট প্রকাশের পর ২০২২ সালের জুলাইয়ে হাইড্রো টেস্টে বিদ্যমান পাইপটি ব্যবহার উপযোগী বলে রিপোর্ট আসে। এরপর ৭ নম্বর কূপের লাইনে হুকিং করে দেওয়ার (রশিদপুর-৯) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপরও কেটে গেছে আরও এক বছর, কিন্তু সুরাহা হয়নি।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, পাইপলাইন নির্মাণের জন্য বনের কিছু গাছ কাটতে হবে। গাছ কাটার অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ২ মাস। আমরা বন বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছি। নতুন সচিব বন বিভাগের সচিবের সঙ্গে কথা বলে তাগাদা দিয়েছেন। আশা করছি এখন আর জটিলতা থাকবে না।
সম্ভাবনাময় কূপটি নিয়ে সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি তথা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের গাছাড়া ভাব ছিল। দেশে চরম সংকটের মধ্যেও কোন গুরুত্ব পায়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে যখন উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ, তখনও নজর পড়েনি পড়ে থাকা কূপটি।
বর্তমানে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানিকৃত এলএনজি দাম পড়ছে প্রায় ১২ ডলারের (এমএমবিটিইউ) মতো। ডলার ১১০ টাকা করে অংক করলেও প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম দাড়ায় প্রায় ৪৭ টাকার মতো। এর সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্স ১০ টাকা ও রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ প্রায় ২ টাকা যোগ করলে ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম পড়ছে ৫৯ টাকার মতো। অথচ রশিদপুর থেকে ১ টাকারও কমমূল্যে গ্যাস পাওয়া সম্ভব।
কম করে হলেও দৈনিক (১৫ মিলিয়ন) ৪ লাখ ২৪ হাজার ৭৫২ ঘনমিটার গ্যাস পাওয়া সম্ভব। যার দাম দাঁড়ায় ২ কোটি ৫০ লাখ ৬০ হাজার টাকার মতো। দৈনিক এই টাকার সাশ্রয় করা এক তুড়ির বিষয়। অথচ সেই কাজটি না করে গ্যাসের ঘাটতি যোগান দিতে কাড়ি কাড়ি ডলার ঢালতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আর সেদিকেই বেশি মনযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বরং দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে গুরুত্ব দেওয়া চিত্রায়ণ দৃশ্যমান। গ্যাস সংকট দূর করার কথা বলে ভোলা থেকে সিএনজি আকারে ৫ মিলিয়ন (প্রথমধাপে) গ্যাস আনার বিশাল তোড়জোড় চলছে। সম্প্রতি ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। কোম্পানিটি ভোলা থেকে গ্যাস পরিবহন করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সরবরাহ করবে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাস পরিবহনের জন্য ৩০.৬০ টাকা দিতে হবে ইন্ট্রাকোকে। শিল্প কারখানায় পাইপলাইনে পাওয়া গ্যাসের জন্য ১৮.০২ টাকা (বৃহৎ শিল্প) পাওয়া গেলেও, এই গ্যাসের মূল্য দিতে হবে ৪৭.৬০ টাকা। খানিকটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি প্রবাদের মতো।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, গ্যাস সংকটের কথা বলে ভোলা থেকে গ্যাস আনার আগে রশিদপুরের গ্যাস আনা যেতো। এক দুই মাসের মধ্যেই যে কাজটি করা যেতো। ভোলা থেকে গ্যাস আনার মতো এখানে কোন ঝুঁকি নেই, এবং নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়া সম্ভব। আবার সেই দামও হতো সাশ্রয়ী। সেই কাজটি কেনো এতদিনে করা যাচ্ছে না সেটাই বড় বিস্ময়ের। ভোলা থেকে প্রথম দফায় আসবে মাত্র ৫ মিলিয়ন, পরে আরও ২০ মিলিয়ন আনার পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ এর সিকিভাব প্রচেষ্টা নিলে ১ টাকারও কম মূল্যে রশিদপুর থেকে কয়েকগুন বেশি গ্যাস আসতে পারতো। সেদিকে না পেট্রোবাংলা, না জ্বালানি বিভাগের কোন আগ্রহ দৃশ্যমান।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেছেন, দেশীয় গ্যাস তুললে যে লাভ তার চেয়ে না তুললে বেশি লাভ। আমদানি করলে কমিশনের বিষয় থাকতে পারে। এটা শুধু আজকে থেকে নয়, ঐতিহাসিকভাবেই অনুসন্ধানে স্থবিরতা বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তন হলে একটা পরিবর্তন আশা করা হয়, কিন্তু সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। বরং পূর্বের ধারার সঙ্গে নতুন ধারা আমদানি যুক্ত করা হয়েছে। এই অবস্থা থাকলে ৩০ সালে গ্যাস খাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, ১৯৬০ সালে আবিষ্কৃত হয় রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড। এখানে প্রমাণিত মজুদ ১০৬০ বিলিয়ন ঘনফুট, সম্ভাব্য রয়েছে ১৩৭৩ বিসিএফ, আরও সম্ভাবনাময় বিবেচনা করা হয় ৬৮০ বিসিএফ। উত্তোলন যোগ্য প্রমাণিত (১পি) ও সম্ভাব্য মিলে মজুদ ধারণা করা হয় ২৪৩৩ বিসিএফ। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাস ক্ষেত্রটি থেকে ৬৭৫ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ রয়েছে ১৭৫৭ বিএসএফ।
অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানায় প্রমাণিত মজুদ ধরা হয় ৪৪১৫ বিসিএফ, সম্ভাব্য বিবেচনা করা হয় আরও ১৩৪০ বিসিএফ। গ্যাস ফিল্ডটিতে ২০২২ সাল ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৯৯১ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। অবশিষ্ট মজুদ রয়েছে মাত্র ৭৬৩ বিসিএফ।
মজুদ বিবেচনায় বিবিয়ানার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি গ্যাস থাকলে উত্তোলনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড। বিবিয়ানা ২৩ আগস্ট ২৬টি কূপ দিয়ে ১০৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে। একই দিনে রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড ৫টি কুপ দিয়ে মাত্র ৪৬.৪ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করেছে। রশিদপুরে এ যাবত ১১টি কূপ খনন করা হয়েছে এর মধ্য ৯টি গ্যাস পাওয়া গেছে। ৯টি কূপ থাকলেও ৩টি বন্ধ ও একটি গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত থাকলেও পাইপলাইনের অভাবে বসে রয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।