সার উৎপাদনের গ্যাস বিল নিয়ে অচলাবস্থা, সরবরাহ বন্ধের শঙ্কা

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সরকার নির্ধারিত দরে গ্যাস বিল দিচ্ছে না রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সার কারখানাগুলো। দফায় দফায় বৈঠক করেও কোন সুরাহা হচ্ছে না। গ্যাস বিতরণ কোম্পানি নতুন দরে বিল দিলেও তারা পূর্বদর অনুযায়ী আংশিক বিল দিয়ে যাচ্ছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপরেশন) মোহাম্মদ জাকীর হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যে দর অনুমোদন দিয়েছে এটা নিয়ে আরও কোন কথা বলার সুযোগ নেই। আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি বিল দেওয়ার জন্য। তাদেরকে বিল দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২০২২ সালের ৬ জুন গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয়। সবাইকে অবাক করে সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর তারপর থেকেই শুরু হয় রশি টানাটানি। সরকারি সার কারখানাগুলো এই আদেশ মানতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। জ্বালানি বিভাগ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ফল পাওয়া যায়নি।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পরিচালক (অর্থ) অর্পণা ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, জামালপুরের সরিষাবাড়িতে অবস্থিত যমুনা সার কারখানা (জেএফসিএল) ও ঘোড়াশালে অবস্থিত ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পিএলসি আমাদের গ্রাহক। তাদেরকে চিঠি দেওয়ার পরও নতুন দরে বিল দিচ্ছে না। কোম্পানি দু’টি আংশিক বিল দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তাদের বিপুল পরিমাণ বকেয়া পড়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালের জুন মাসে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হয়। জুন থেকে এখন পর‌্যন্ত যমুনা সার কারখানার গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে ৩৩১ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর ঘোড়াশাল সার কারখানার বিল বকেয়া পড়েছে ৪৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ওই দুই সার কারখানায় পূর্বের বকেয়া রয়ে গেছে ৪৬৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ চলমান রয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা না দিলে কি ভাবে দেবে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মালিকানাধীন সার কারখানার বকেয়ার বিষয়টি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একাধিক মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নুরুল আলমের সভাপতিত্বে সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ তারিখে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়। সভায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জানান, বিসিআইসি যেহেতু বকেয়া পরিশোধে কার্যক্রর কোন রোডম্যাপ দেয়নি সেহেতু তাদেরকে জোর তাগিদ দিতে হবে।

এর আগের মাস আগস্টে (৩০ আগস্ট) অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় যুগ্মসচিব (অপরেশন-২) জানান, বিসিআরসির পক্ষ থেকে পুনঃনির্ধারিত মূল্য ১৬ টাকা হারে গ্যাস বিল পরিশোধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির প্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় হতে আশানুরূপ কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ওই সভায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছিলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভায় শিল্প সচিব পূর্বের হারে বিল প্রদানের বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি জ্ঞাপনের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর নতুন দর কার্যকর না করা দাফতরিক শোভনীয়তার পরিপন্থী। বিষয়টি সমাধান না হলে অচিরেই সার কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হতে পারে মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

ওই সভায় জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নুরুল আলম বিল আদায়ে নিবিড় যোগাযোগ এবং বর্তমানে দেশে সারের চাহিদা, উৎপাদন খরচ ও আমদানির তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করার নির্দেশনা প্রদান করেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমরা নতুন দরে বিল দিতে চাচ্ছি না বিষয়টি এমন না। গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার পর প্রতিকেজি ইউরিয়ার উৎপাদন খরচ ১৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা হয়েছে। সরকার কেজি প্রতি ৫ টাকা করে বাড়িয়ে ২২ টাকা করেছে। এতেও ট্রেড গ্যাপ রয়ে গেছে।

এই ধরনের গ্যাপের ক্ষেত্রে সরকার কিছু নীতি সিদ্ধান্ত থাকে। ট্রেড গ্যাপ পুরনের জন্য ভর্তুকি দিয়ে থাকেন। আমাদের বায়ার হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়, সরকার কার মাধ্যমে ভর্তুকি দেবে সেটাই মূখ্য। আমরা অর্থমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পেলেই বিল পরিশোধ করা হবে। পূর্বের হারে বিল পরিশোধ করে যাওয়া হচ্ছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান বিসিআইসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়া সার কারখানাগুলো হচ্ছে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল), আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (এএফসিসিএল), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ও শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (এসএফসিএল)। আর যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কেএএফসিও)। কোম্পানিটির সাড়ে ৪৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সরকারের হাতে।

পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ তথ্য অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানির ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে .০৩ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘোড়াশাল পলাশ কারখানায় ৭২ মিলিয়নের বিপরীতে ৫২.৫ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে ৫২.১ মিলিয়নের বিপরীতে ৪১.১ মিলিয়ন ঘনফুট। শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানির ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ৬.৮ মিলিয়ন এবং কাফকোর ৬৩ মিলিয়নের বিপরীতে ৪৪.৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়। অন্যদিকে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে এদিন কোন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়নি।

ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (ইউএফএফএল) এবং পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (পিইউএফএফএল) একীভূত করে ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (জিপিএফপিএলসি) গঠিত হয়। নতুন এই কোম্পানিটি বছরে ৯ লাখ ২৪ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদন করতে পারবে। শিগগিরই এই সারকারখানা উদ্বোধনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৭ লাখ টন। অন্যদিকে ডিএপি ১৬ লাখ টন, সাড়ে ৭ লাখ টন টিএসপি, ৯ লাখ ৩০ হাজার টন এমওপি, ৩০ হাজার টন এনপিকেএস, সাড়ে ৫ লাখ টন জিপসাম, এক লাখ ৪০ হাজার টন জিংক সালফেট, ২ হাজার ৫০০ টন অ্যামোনিয়াম সালফেট, ৯০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম সালফেট এবং ৫০ হাজার টন বোরনের চাহিদা নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।